ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরকার ও সরকার বিরোধীদের নানামুখী বক্তব্য ও তৎপরতায় সৃষ্টি হয়েছে একরকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির। দিন যতই যাচ্ছে, এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে ঘোলাটে হচ্ছে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও- এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

 

এর বিরূপ প্রভাব আগামী জাতীয় নির্বাচনের ওপর পড়তে পারে, যা সুষ্ঠু ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিঘ্ন ঘটাতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের আরও অভিমত, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। অতীতের সব শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সবাইকে সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয়। যাতে দেশে সত্যিকার গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকে এবং রাখা যায়, সেজন্য ক্ষমতায় থাকা বা আসাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না।

 

বরং আগামী জাতীয় নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করা যায়, সেদিকে সবার নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব সরকারের। এরপরে রয়েছে বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর। তারা বলেন, জনস্বার্থে এই মৌলিক বিষয়টি গ্রহণ বা ধারণ করলে ষোড়শ সংশোধনীর রায় বাতিল বা বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি বাস্তবায়ন কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।

কিন্তু দেশের স্বার্থে রাজনীতিবিদরা এই ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা প্রকাশ করতে না পারলে সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে।

 

আর রাজনীতিবিদদের ভুলের কারণে যদি সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়, তাহলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না হলেও নতুন কোনো ঘটনা ইতিহাসে জায়গা করে নেবে। সে দায় রাজনীতিবিদদের ওপর বর্তাবে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যেসব কথা বলছেন তাতে সেই চিত্রই ফুটে উঠছে। আদালতের রায় নিয়ে এত বিতর্কের কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে- ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ স্বাধীন করেছি, ঐক্যবদ্ধভাবে এ দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। সবকিছু প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করতে হবে। আশা করি আদালতের এ আহ্বান সংশ্লিষ্ট সবাই আমলে নেবেন, যাতে ভবিষ্যতে আমরা একটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারি।

রায় নিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান খায়রুল হকের মন্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিচারপতি খায়রুল হকই সব অঘটনঘটনপটীয়সী। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায় ছিল বাড়াবাড়ি। এ কারণেই আমরা আজ বিপদের মধ্যে আছি। দেশটা আজ ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।

 

তিনি বলেন, বর্তমান এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সব রাজনৈতিক দলকে সহনশীল ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। না হলে আমরা খাদে পড়ে যেতে পারি। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিমকোর্টের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায় ও কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়ার পর থেকেই হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। আওয়ামী লীগ রায়ের পর্যবেক্ষণের কিছু মন্তব্যকে ‘আপত্তিকর’ বলে অভিযোগ করে আসছে।

গত শনিবার বিষয়টি প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে তার বাসভবনে গিয়ে জানিয়ে এসেছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

এরপর সোমবার বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরকার ও আওয়ামী লীগের প্রকৃত অবস্থানের কথা জানান তিনি। এ অবস্থার মধ্যেই বুধবার সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাক্ষাৎ করেন।

 

এ সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হকসহ দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম উপস্থিত ছিলেন।

এদিন রাতে বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে ওবায়দুল কাদের সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি স্বীকার করেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাদের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় ও রায়ের পর্যবেক্ষণের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ নিয়ে আরও আলোচনা হবে বলেও জানান তিনি। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি কোনো পরামর্শ দিয়েছেন কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এখন তা বলা যাচ্ছে না।’

জানা গেছে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায়, অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাবিধি, আইনসচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বৈধতা এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বিচারিক ক্ষমতা রহিত- এই চারটি বিষয় সরকারের এখন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে উচ্চ আদালতের সঙ্গে ও সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন অনেকটাই প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে।

 

রায়ের পর্যবেক্ষণের আপত্তিকর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা মাঠে নেমেছেন। তারা প্রতিবাদ-বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন। এ নিয়ে জনমত তৈরিতে সারা দেশে চলছে নানা কর্মসূচি। এরই অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মী এবং মন্ত্রিসভার সদস্যরা প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশে রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে তাদের তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে যাচ্ছেন। গত ক’দিন ধরেই রায় নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের পাল্টাপাল্টি সমাবেশে উত্তপ্ত রয়েছে সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণসহ সারা দেশের আদালতপাড়া।

 

এছাড়া রায় নিয়ে একইসঙ্গে সরকারের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা যার যার মতো করে মন্তব্য করছেন ও ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ক্ষমতাসীন দলের পাশাপাশি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকও রায় নিয়ে দুই দফা আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেন। ৯ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে রায় সম্পর্কে তিনি বলেন, রায়ে জুডিশিয়ারির বাইরে অনেক মন্তব্য করা হয়েছে। সুপ্রিমকোর্ট ভুল করলে যাব কোথায় বলে জানান তিনি। তার এমন বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপি। সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সাবেক ওই প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করেন।

 

এদিকে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘রায়ে অপ্রাসঙ্গিক কথা আছে। রিভিউয়ে সেগুলোও আসবে। সরকার তার জন্য তৈরি হচ্ছে’।

 

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে করা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি ১ আগস্ট প্রকাশ করে সুপ্রিমকোর্ট। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। এর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় সরকার। এর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় ১০ আগস্টের সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী বলেন, মামলার ‘ফ্যাক্ট অব ইস্যুর’ সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন ‘অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা’ প্রধান বিচারপতি তার রায়ে বলেছেন।

 

এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব,) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সরকারি দল রায় নিয়ে কোনো অসুবিধা নেই বলছে। তবে রায়ের অবজারভেশন নিয়ে তাদের বক্তব্য আছে। বিষয়টি আইনি বিষয় হলেও এটাকে রাজনৈতিকভাবে দেখা হচ্ছে। রায় নিয়ে বিএনপির উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ রায়ে জিয়াউর রহমান সম্পর্কেও বলা হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমাদের বড় দুই দলের মধ্যে টানাপোড়েন রয়েছে। রায় তাদের মাঝখানে পড়ে গেছে। এটাকে নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলে সরকারি বা মাঠের বিরোধী দল কেউ লাভবান হবে বলে মনে করি না।

সাখাওয়াত বলেন, রায়ের রিভিউতে উচ্চ আদালত এক্সপাঞ্জ করবে কিনা জানি না। তবে এক্সপাঞ্জ করলেও একটি ভুল বার্তা যাবে। সাধারণ মানুষ মনে করবে সরকার বিচার বিভাগের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এসব করছে। এমন পরিস্থিতি কারও জন্যই ভালো হবে না। রাজনৈতিক ইস্যু রাজনৈতিক দলগুলো কিভাবে মোকাবেলা করে সেটা তাদের ব্যাপার।

 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সমঝোতার কোনো লক্ষণ এখন দেখছি না। নির্বাচন কমিশন থেকে যেসব বক্তব্য দিচ্ছে তাতেও কোনো আশার বাণী দেখছি না। তবে ভবিষ্যতে কী হবে বলা যাচ্ছে না। এ মুহূর্তে সমঝোতা হওয়াটা সুদূরপরাহত।

তিনি বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব দলকে আলোচনায় আসতে হবে। একটি সমঝোতায় পৌঁছতে হবে।

কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের অভিমত, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এতে সামনের পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলতে পারে। কমিশনের ভূমিকা নিয়ে এখন পর্যন্ত ততটা সন্তুষ্ট নন সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় আনতে সফল হতে পারেননি তারা।

এ প্রসঙ্গে এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। সব দলকে সমান সুযোগ দিতে হবে। রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আস্থা অর্জন করতে হবে। এজন্য কমিশনের সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

জানতে চাইল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, রায়ের পর সরকারের পক্ষ থেকে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে এটা বিস্ময়কর এবং অনাকাক্সিক্ষত। দেশের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে সরকারের যে দৃষ্টিভঙ্গি সেটার বেদনাদায়ক চিত্র ফুটে উঠেছে। এর আগে চারটি সংশোধনী বাতিল হলেও কোনো রাজনৈতিক দলকে এভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখিনি। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের ভেতরের ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরার চেয়ে সরকার এটাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে। যেভাবে প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করা হচ্ছে, যেভাবে কিছু মন্ত্রী কথা বলেছেন তাতে মনে হয় বিচার বিভাগের যে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে এটা মানার মতো মানসিকতা তাদের নেই। কোনো কোনো মন্ত্রী আদালত অবমাননাকর বক্তব্য দিয়েছেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সবুজ সংকেত ছাড়া সরকারি পদে থেকে কর্মরত আইন সচিবের মতো একজন কর্মকর্তা কিছু বলতে পারেন না। আইন সচিব ও আইন কমিশনের প্রধানের বক্তব্য বিস্ময়কর।

তিনি বলেন, সরকারের যদি বোধোদয় না হয়, তারা যদি মনে করে প্রধান বিচারপতিকে ইচ্ছা করলেই তারা তাকে বিপদে ফেলতে পারবে, পদত্যাগে বাধ্য করতে পারবে বা অপসারণ করতে পারবে- এমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যদি আগায়, তবে অবশ্যই দেশে একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতে পারে। তাই সরকারের অনুধাবন করা উচিত এটা উচ্চ আদালতের সর্বসম্মত রায়। এ রায়ের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে যতটা করা সম্ভব তাই করা। আইনগত পরিসীমার বাইরে গিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত নয়।

 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাদা ছোড়াছুড়ির চেয়ে বড় কথা সরকারের আচরণে মনে হয় রাষ্ট্রের মালিকানা তারা। এমন আচরণের মধ্যে আগামী নির্বাচন দিলে বিরোধী দলের যে আশঙ্কা রয়েছে তা আরও জোরদার হবে। যুগান্তর

 


Comments