ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিএনপি-জামায়াত রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চিন্তা করছে বলে জানা গেছে।
এর অংশ হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং দশম সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ১৫৪ সংসদ সদস্যের পদে থাকার বৈধতা প্রশ্নে খারিজ রিটের বিরুদ্ধে রিভিউয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিএনপি-জামায়াতপন্থি আইনজীবীরা। তবে তাদের এ পদক্ষেপের বিষয়ে চিন্তিত নয় আওয়ামী লীগ। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে তথ্যটি জানা গেছে।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সরগরম দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় থেকে ‘আপত্তিকর পর্যবেক্ষণ’ এক্সপাঞ্জের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রপক্ষ ওই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের এ রায় নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সাময়িক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
এ সুযোগকে কাজে লাগাতে চাচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধানসংবলিত সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত রায়ের রিভিউ উচ্চ আদালতে আনা হতে পারে। একই সঙ্গে দশম জাতীয় সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ১৫৪ সংসদ সদস্যের পদে থাকার বৈধতা প্রশ্নে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি খুরশিদ আলম সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চে খারিজ করা রিটের রিভিউয়ের বিষয়েও প্রস্তুতি চলছে বিএনপি-জামায়াতের অন্দরমহলে। বিএনপি-জামায়াতপন্থি আইনজীবীদের সঙ্গে আলাপকালে বিষয়টি জানা গেছে।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয় গত ১ আগস্ট। রায়ে দেশের শাসনব্যবস্থা, জাতীয় সংসদ, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন মন্ত্রিসভার সদস্যসহ সরকারের নীতিনির্ধারকরা। এর পর আওয়ামী লীগ ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতারা বিষয়টি নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেন। সরকারের পক্ষ থেকে গত ১০ আগস্ট আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে প্রধান বিচারপতি যেসব আপত্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য দিয়েছেন, সেগুলো এক্সপাঞ্জ করার উদ্যোগও আমরা নেব।’ তিনি বলেন, ‘রায়ে সরকার দুঃখিত। কারণ এই রায়ের পর্যবেক্ষণে ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে যে মন্তব্য করা হয়েছে, তা যুক্তিতাড়িত নয় বরং আবেগ বা বিদ্বেষতাড়িত।’
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সরকারি দলের নেতাদের আচরণে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে বলে ভাবছে সরকারবিরোধী মহল। এই পরিস্থিতিতে সরকারকে আরও বেকায়দায় ফেলার জন্য নতুন করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় ও বিনা ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের বিষয়ে খারিজ করা রিটের রিভিউ আবেদনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন ৭ সদস্যের আপিল বিভাগ বেঞ্চ ২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে রায় দেন। রায়ে বলা হয়, ‘১৯৯৬ সালে আনা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে বাতিল করা হলো। তবে পরবর্তী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অর্থাৎ দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে। যদিও এই ব্যবস্থা আইনসম্মত নয়, তথাপি সময়ের প্রয়োজনে এই ব্যবস্থাকে বৈধতা দেওয়া গেল। রাষ্ট্র ও জনগণের বৃহত্তর নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার কথা বিবেচনা করে পরবর্তী দুই মেয়াদের জন্য এটা করা হলো। আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে এ রায় দেওয়া হলো।’
সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন এ ব্যাপারে আমা বলেন, ‘আদালতে রায় ঘোষণার সময় পরবর্তী দুটি মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনের নির্বাচন করা যেতে পারে বলে জানানো হলেও পরে পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা ছিল না। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের দেওয়া ওই রায়ে এই বিষয়টি উল্লেখ করেই যে কেউ জনস্বার্থে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে রিভিউ করার জন্য বিলম্ব হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ উল্লেখ করতে হবে। আর সর্বোচ্চ আদালত যদি মনে করেন এই বিলম্ব আবেদন গ্রহণ করে রিভিউ শুনানি করতে পারেন।’
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৪ সংসদ সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার বৈধতা প্রশ্নে করা রিট হাইকোর্টে খারিজের ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক এ সভাপতি বলেন, এখন ওই রিটেরও রিভিউ আবেদন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রেও বিলম্বের যুক্তিসঙ্গত কারণ ও ব্যাখ্যা দিতে হবে। হাইকোর্ট তা গ্রহণযোগ্য মনে করলে সে বিষয়েও শুনানি হতে কোনো আইনগত বাধা থাকবে না।সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, কোনো মামলায় পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর বাদী বা বিবাদী নির্ধারিত ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন না করলে পরে যে কেউ বিলম্বের কারণ দেখিয়ে জনস্বার্থে রিভিউ আবেদন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ের ব্যাপারেও রিভিউ হতে পারে। এমনকি ১৫৪ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যের রিটের ব্যাপারেও রিভিউয়ের সুযোগ আছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারসংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করা যাবে কিনাÑ এ বিষয়ে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক আমাদের সময়কে বলেন, কোনো মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন না করলে পরে যে কেউ বিলম্বের যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়ে জনস্বার্থে রিভিউ আবেদন করতে পারেন। বিগত নির্বাচনে ১৫৪ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যের রিটের বিষয়েও তিনি একই কথা বলেন। না হয়ে থাকলে সব ক্ষেত্রেই রিভিউ আবেদন সম্ভব বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী আমাদের বলেন, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমেই বিএনপির জন্ম, তাই ষড়যন্ত্র ছাড়া কোনো কিছু চিন্তা করতে পারে না দলটি। তিনি বলেন, আগস্ট মাস এলেই বিএনপির ষড়যন্ত্রের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্টের ধারাবাহিকতায় এবার আগস্ট মাসে ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসার চক্রান্তে লিপ্ত বিএনপি।
ত্রয়োদশ সংশোধনী রিভিউ এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের রিটের রিভিউয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্রে আমরাও এমনটি শুনেছি বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা কিছু প্রস্তুতি নিচ্ছে, তবে এ বিষয়ে কোনো সঠিক তথ্য আমাদের কাছে নেই। তিনি বলেন, তবে সময় এবং মামলার গুণাগুণ বিবেচনা করে আমরা যেটা বুঝি, ইতিবাচক কোনো ফল পাওয়ার সম্ভাবনা বিএনপির একেবারেই নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, সরকার যখন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে যাওয়ার বিষয়ে ভাবছে, তখন সরকারবিরোধী কিছু মহল এ দুই মামলাকে আলোচনায় নিয়ে আসতে চাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সবসময় জনগণের রায়ে বিশ্বাসী। বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক যে কোনো চাল মোকাবিলা করার সক্ষমতা আওয়ামী লীগের আছে। বিএনপির পদক্ষেপ নিয়ে চিন্তিত নয় আওয়ামী লীগ।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে উচ্চ আদালতের রায় এবং রায়ের উল্লিখিত কিছু পর্যবেক্ষণে বিব্রত সরকার। রায়ে সরকারের জন্য আপত্তিকর বিষয়গুলো এক্সপাঞ্জের লক্ষ্যে রিভিউ আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষ। নিয়মতান্ত্রিক এই প্রক্রিয়ায় সন্তুষ্টি না এলে প্রধান বিচারপতির বিপক্ষে হার্ডলাইনে যাওয়ার বিষয়েও চিন্তাভাবনা রয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে। সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদের দ্বারস্থ হওয়ার পক্ষেও মত দিয়েছেন আওয়ামী লীগে কিছু জ্যেষ্ঠ নেতা। তবে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো মন্তব্য করেননি এখনো।
সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে প্রধান বিচারপতি তাঁহার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে ক্ষেত্রমতো অন্য কোনো ব্যক্তি অনুরূপ পদে যোগদান না করা পর্যন্ত কিংবা প্রধান বিচারপতি স্বীয় কার্যভার পুনরায় গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপিল বিভাগের অন্য বিচারকদের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণতম, তিনি অনুরূপ কার্যভার পালন করিবেন।” উৎসঃ দৈনিক আমাদের সময়