ভুটানের ডোকলাম উপত্যকা নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে চাপানউতর বিরাজ করছে। উভয় দেশ সেখানে সেনা মোতায়েন রেখে যুদ্ধ পরিস্থিতি জিইয়ে রেখেছে। চীন-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে কোন দেশ সবচেয়ে বিপদে পড়বে, তা নিয়ে শনিবার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আনন্দবাজার পত্রিকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন ও ভারতের মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশের ওপর ভারত তার সামরিক অবস্থান জোরদার করবে।
ভারত চাপ সৃষ্টি করবে, যাতে চীন তাদের কাছ থেকে কোনো সুবিধা না পায়। অন্যদিকে বেইজিংও তৎপর হবে, প্রতিবেশী দেশগুলো যেন কোনোভাবেই ভারতের তৃতীয় পক্ষ না হয়ে ওঠে।
কিন্তু সত্যি সত্যি দিল্লি যদি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে তার তৃতীয় পক্ষ হতে বাধ্য করে বা সেসব দেশে দিল্লির সামরিক উপস্থিতি ঘটে, তবে এ দেশগুলোয় ভারতবিরোধী রাজনীতি আরও জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যার সুযোগ নেবে বেইজিং।
বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান বা শ্রীলংকায় যতই ভারতের ‘বন্ধু সরকারের’ উপস্থিতি থাক, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির এ চাপকে উপেক্ষা করা তাদের পক্ষে কঠিন হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দিল্লির পক্ষে আরেকটি উদ্বেগের কারণ হবে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছন্নতাবাদী সংগঠনগুলো। চীন-ভারত সংঘাতের সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চাইবে না। সেই সুযোগ নিয়ে তারা সেখানে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
ফলে শিলিগুড়ি করিডোরকে সুরক্ষিত রাখতে এবং সামগ্রিকভাবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ভারতকে তখন একসঙ্গে দুটি ফ্রন্টে লড়াই করতে হবে। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলোকে দমনে দিল্লি এর আগে ভুটান, মিয়ানমার, নেপাল ও বাংলাদেশের সাহায্য পেয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হলে এ দেশগুলোর ওপর ভারত আবার চাপ সৃষ্টি করবে। কিন্তু তখন ভারতকে সমর্থন দিতে গেলে চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। তাই দিল্লির চাপে তারা কতটা সাড়া দেবে, তা নিয়ে প্রশ্নের যথেষ্ট অবকাশ থেকে যাচ্ছে।
ভারতের জন্য আরেকটি দুঃসংবাদ হতে পারে দক্ষিণ চীন সাগরে অবরোধ। এ অঞ্চল ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ। চীন স্বভাবতই বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি করে দিল্লিকে বিপাকে ফেলতে চাইবে। সম্প্রতি এ রকম একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে, বেইজিং রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতিকে কখনও মেশায় না। বাস্তবে কিন্তু এর উল্টোটাই বেশি দেখা গেছে।
যেখানে চীনের স্বার্থ বিপন্ন হয়েছে, বেইজিং বাণিজ্যকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া চীনের আপত্তি অগ্রাহ্য করে মার্কিন ‘থাড’ ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছে, তার প্রতিক্রিয়ায় বেইজিং দেশটির ওপর অর্থনেতিক অবরোধ আরোপ করেছে। একই ঘটনা মঙ্গোলিয়া, ফিলিপাইন বা জাপানের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। গত বছর দালাইলামা মঙ্গোলিয়া সফর করেন। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ বেইজিং মঙ্গোলিয়ার পণ্যের ওপর শাস্তিমূলক জরিমানা আরোপ করে। ২০১২ সালে জাপানের সঙ্গে সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ এবং ফিলিপাইনের সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগরে স্কারবরো বালুচর নিয়ে বিবাদের জেরে দেশ দুটির ওপর বাণিজ্য অস্ত্র প্রয়োগ করে চীন।
আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চীন এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিরুদ্ধে এ রকম পদক্ষেপ নেয়নি। তার একটা কারণ হল, ভারতে চীনের রফতানি-আমদানির তুলনায় পাঁচগুণ বেশি। কিন্তু দেশটি এ পথে কখনও হাঁটবে না, এমন ধারণা করাও যৌক্তিক নয়। চীন এমনটা না করলেও তার ঘনিষ্ঠদের চাপ দিয়ে এ পদক্ষেপে বাধ্য করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান তখন দিল্লির ডাকে কতটা সাড়া দেবে, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। কেননা উত্তর কোরিয়াকে সামলাতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন চীনকে।
অন্যদিকে রয়েছে চিরবৈরী দেশ পাকিস্তান। চীন আগেই বলেছে, ভারত যদি তৃতীয় পক্ষ হয়ে ভুটানে সেনা মোতায়েন করতে পারে তবে তারা পাকিস্তানের হয়ে কাশ্মীরে অবস্থান করবে। চীন-ভারত সংঘাতের সুযোগ নিতে পাকিস্তানও ছাড়বে না। কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠবে।
এ তো গেল যুদ্ধকালীন অবস্থা। সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা হবে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে। দক্ষিণ এশিয়ার ভঙ্গুর অর্থনীতিতে বড়োসড়ো ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সঙ্গে, যুদ্ধে যদি ভারত সত্যই পরাজিত হয় (সেই সম্ভাবনাই বেশি), দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে চীনের আধিপত্য আরও জোরদার হবে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির অভিমুখ চীনের দিকে ঘুরে যেতে পারে।
এমনিতেই দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারত ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। চীন-ভারত যুদ্ধের ফলে ভারতের দেহে ‘স্পেনীয় ক্যান্সারের’ মতো গভীর ক্ষত তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। স্পেনীয় ক্যান্সার নেপোলিয়নের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল, কিন্তু চীন-ভারত যুদ্ধ শুধু নরেন্দ্র মোদির মর্যাদাহানিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, গোটা দুনিয়ায় ভারতের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হবে। সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা