হৃদকম্পন বাড়ছে দ্রুত গতিতে। বুক জুড়ে হাহাকার। বীভৎস, বর্বর, মর্মান্তিক, অমানবিক। মগদের কাছে এসব এখন আর কোনো বিশেষণ নয়। মগের মুল্লুকে যা হচ্ছে তা নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে।

 

গলা কেটে হত্যা, পিষে হত্যা, ধর্ষণের পর খুঁচিয়ে হত্যা, নারী, পুরুষকে উলঙ্গ করে গাছে বেঁধে হত্যা, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, টুকরো টুকরো করে হত্যা। শুধু হত্যা করেই মগরা ক্ষান্ত হয়নি। লাশের চামড়া তুলে উল্লাসের দৃশ্যও প্রযুক্তির কল্যাণে দেখছে বিশ্ববাসী।

 

কিন্তু কারো কিছুই করার নেই। নির্দয় মগ ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ঠান্ডা মাথায় খুন বিশ্বকে কাঁদাচ্ছে। আর তাইতো নিজেদের ধন সম্পদ সব ছেড়ে জীবন বাঁচাতে সবাই ছুটছে বাংলাদেশে। পাহাড়, জঙ্গল পেরিয়ে, খেয়ে না খেয়ে শত মাইল হেঁটে পাড়ি দিয়ে রাখাইন রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে। শত মাইল পাড়ি দিতে গিয়েও পথে পথে মৃত্যুফাঁদ পেরুতে হয়েছে তাদের। পালিয়ে আসা এক রোহিঙ্গার করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে এপির একটি ছবিতে।

 

এপির ফটোগ্রাফার দার ইয়াসিনের তোলা ওই ছবিতে মৃত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন এক তরুণী মা হামিদা বেগম। কখনো চুমু দিচ্ছেন। কখনো সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছেন। পোড়া লাশের গন্ধ পেরিয়ে, চোখের সামনে স্বজনদের জবাই করতে দেখেও হামিদা আশায় বেঁচেছিলেন।

 

নাড়িছেড়া ধনকে বাঁচাতে সব ছেড়ে অজানার উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। পথে পথে হাজারো বাধা টপকিয়েছেন সাহসের সঙ্গে। চোখে মুখে তার স্বপ্ন ছিল নিজ শিশু সন্তানকে বাঁচাতেতো পারছেন। নিঃস্ব হয়ে জন্মস্থান ত্যাগ করলেও আদরের সন্তানের মুখ দেখে সব কষ্ট ভুলে যাবেন। আর এ স্বপ্ন নিয়েই নাফ নদ পাড়ি দিচ্ছিলেন নৌকায়। বাংলাদেশ সীমান্তের মাত্র কয়েক মিটার দূরে নৌকাটি ডুবে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নাফ নদে মিলিয়ে যায় হামিদার স্বপ্নও। কোলের শিশু আবদুর মাকসুদও কোমর সমান পানিতে ডুবে গেছে। যখন পানি থেকে ওঠানো হয় তখন মাকসুদের নিথর দেহ।

 

শিশুকে কোলে নিয়েই বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন হামিদা। যে শিশুকে কোলে নিয়ে দিনের পর দিন হেঁটে বাংলাদেশে পৌঁছেছেন সেই শিশু এখন প্রাণহীন। যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে হামিদার মাথায়। চিৎকার করে কাঁদছিলেন হামিদা। মাকসুদের লাশের মুখে, কপালে চুমু দিয়ে আদর করছিলেন। এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত সবার চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে। হামিদার এখন অনেক কাজ বাকি। রাতে ঘুমানোর জায়গা খুঁজতে হবে। পেটের দানা পানির ব্যবস্থাও নেই। কত দিন পেট পুড়ে খায়নি।


এপির ফটোগ্রাফার দার ইয়াসিন এ ছবি সম্পর্কে বলেন, এ ঘটনা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে। হামিদা সন্তানের লাশ বারবার চুমু খাচ্ছিল। কিন্তু সন্তানের জন্য শোক প্রকাশ করার মতো সময়ও তার হাতে ছিল না। কারণ পরিবারের অন্য সদস্যরা আহত। সামনে এগুতে হবে তাদের।

 

ইয়াসিন বলেন দুই কন্যা সন্তানের বাবা হিসাবে এই ঘটনা আমাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছে। শুধু হামিদাই নয়, ২৫শে আগস্ট থেকে রোহিঙ্গ নিধনযজ্ঞে কত যে কাহিনীর জন্ম দিয়েছে তা দিন দিন বেরিয়ে আসবে। পিতা, মাতা, ভাই, স্বজনকে বেঁধে রেখে কন্যাকে ধর্ষণ। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের পর সবার সামনে গলা কেটে হত্যা। সবশেষে সবাইকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা একাধিক। উগ্র বৌদ্ধরা এমন অমানুষ তা না দেখলে বুঝা মুশকিল। নিজের বাড়ি ঘর, ধন সম্পদ, অর্থ কড়ি রেখে পালিয়ে আসা ভীষণ কষ্টের। সেই কষ্টকেই রোহিঙ্গারা আলীঙ্গন করেছে হাসি মুখে। প্রাণের বিনিময়ে। প্রাণে বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে অনেক কিছু হবে। আর মরে গেলেতো কিছু করার থাকবে না। এমন প্রতিজ্ঞা নিয়েই তারা বেঁচে আছে।

 

লাখ লাখ রোহিঙ্গার মাঝে এমন অনেক শিশু রয়েছে যে কেবল হাজার হাজার মানুষের পেছন পেছন ছুটেছে। সে কিছু না বুঝেই এগিয়েছে। এখন বাংলাদেশে একা একা হাঁটছে। হঠাৎ হঠাৎ মা’র জন্য কেঁদে উঠছে। অবর্ণনীয়, অমানবিক এমন দৃশ্য এখন কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফজুড়ে। চল্লিশ বছরের আবদুল মজিদ তার আশি বছরের মাকে কাঁধে করে ৬৩ মাইল পথ হেঁটে বাংলাদেশে এসেছেন। সাংবাদিকদের মজিদ জানান, এমন নৃশংস ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটেনি। বছরের পর বছর আমরা নাগরিকত্ব ও ভোটারবিহীন ছিলাম। তারপরও বেঁচে ছিলাম আশা নিয়ে। একদিন আমরা সব ফিরে পাব। যেখানে আমার দাদার জন্ম, পিতার জন্ম, আমার জন্ম, আমার সন্তানের জন্ম। যেখানে কেটেছে শৈশব। যে মাটির গন্ধ শুকে জীবনের ৪০টি বসন্ত পার করেছি। আজ সেই মাটি থেকে আমাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে।

 

আর এই উচ্ছেদ অভিযান সফল করতে গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সুন্দরীদের সবার সামনে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করছে সেনাবাহিনী। মগরাও বসে নেই। যে যেভাবে পারে আমাদের সম্পদ লুটের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। চোখের সামনে জাতি ভাই ও স্বজনদের নির্মমভাবে হত্যা করার দৃশ্য দেখে মাকে নিয়ে বেরিয়ে যাই। স্ত্রী সন্তানকে আগেই একটি পাহাড়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম অন্যদের সঙ্গে। মাকে নিয়ে এসে দেখি ওরাও নেই। জানতে পারলাম অন্যদের সঙ্গে ওরাও বাংলাদেশ অভিমুখে যাত্রা করেছে। আজ পাঁচ দিন হলো বাংলাদেশে এসেছি। ওদের খুঁজছি। এখনও পাইনি। নির্মমতার বর্ণনা দিয়ে আবদুল মজিদ বলেন, রাতে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ পাশের গ্রামে চিৎকার আগুন আগুন। কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ। বুঝতে আর বাকি রইল না। এর কিছুক্ষণ পরই পার্শ্ববর্তী মগরা এসে আমাদের গ্রামে হামলা চালায়। লুটপাট চালায়। দেশীয় অস্ত্র নিয়ে যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে। এমন দৃশ্য বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। ওদের একটাই কথা- তোরা মিয়ানমারের কেউ না। তোদের প্রাণে শেষ করে দেব। অথচ এক সময় আমাদের ভোটাধিকার ছিল। মিয়ানমারের নাগরিক ছিলাম আমরা। সংসদে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি ছিল। এসবই এখন অতীত। মজিদ বলেন, কখনো ভাবিনি নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে ভিখারির মতো বসবাস করবো। তার কথা- সামরিক জান্তারা ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম।

 

মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি আমাদের কেড়ে নেয়া নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেবেন। ভোটাধিকার ফিরে পাবো। আসলে সবই আমাদের ভুল ধারণা ছিল। এখন দেখি অং সান সুচির মিয়ানমারের চেয়ে সামরিক জান্তার মিয়ানমারই ভালো ছিল। তখন মগরা অন্তত এত বেপরোয়া ছিল না। মজিদ বলেন, এমন বিপদের সময় মগ পাড়ার মেম্বার যে কিনা আমার পরম বন্ধু তাকে ফোন দিয়ে সাহায্য চেয়েছিলাম। সে বলেছে, একমাত্র সাহায্য প্রাণ দেয়া। অবাক হই তার কথায়। পৃথিবীর জঘন্যতম ঘটনা রোহিঙ্গা জাতিকে বিনাশ করার যৌথ পরিকল্পনা এখন বাস্তবায়ন করছে সুচি। ব্যবহার করছে সেনাবাহিনী আর মগদের।

 


Comments