অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী
নিয়ম না মানা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ও সনদ অবৈধ ঘোষণার বিষয়টি ঠিক করবার জন্য আমি দীর্ঘ চার বছর ধরে স্ট্রাগলিং করেছি। এখন ইউজিসি যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে এবং এটা এপ্রিসিয়েট করা উচিত।
যদি ভাইস চ্যান্সেলর এবং প্রো ভাইস চ্যান্সেলর এর যে কোনো একটি পদ শূন্য থাকে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বাধাগ্রস্থ হয়। এরা না থাকলে হিসাব নিকাশের ব্যাপারটিও কন্ট্রোল করা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়।
প্রো ভাইস চ্যান্সেলর, ভাইস চ্যান্সেলরকে সহায়তা করে আর ভাইস চ্যান্সেলর না থাকলেতো একাডেমিক কার্যক্রমই বন্ধ হয়ে যায়।
সুতরাং একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই তিনটি পদেই যোগ্য লোক থাকা প্রয়োজন। এটা প্রয়োজন হলেও অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৩৯ টিতে উপাচার্য নেই, ৬৯ টিতে উপ-উপাচার্য নেই। এই পদগুলো শূন্য থাকার পেছনেও অনেক কারণ আছে।
একটি কারণ হলো, যদি উপাচার্যকে যথাযথভাবে চ্যান্সেলর কর্তৃক নিয়োগ দেওয়া হয় তার বৈধতা এবং পাওয়ার এক্সারসাইজ করার ক্ষমতা এটা ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য বা উপাচার্য ডেজিগনেট থেকে অনেক বেশি।
ট্রাস্টি বোর্ডের মেম্বারেরা অনেক সময় উপাচার্য ডেজিগনেট করে চালিয়ে দিয়ে উনাকে দিয়ে কাজ করায়। এই কাজ করাতে তাদের সুবিধা হলো, এই ট্রাস্টি বোর্ড সবকিছ্ইু তাদের মাধ্যমে প্রেসারাইজড করে করাতে সক্ষম হয়। তাই তারা খুব সিরিয়াসলি প্রোপার পার্সন নিয়োগে সচেষ্ট হন না। এটা ট্রাস্টি বোর্ডের গাফিলতি।
আবার অন্য পক্ষে এই নিয়োগের জন্য শিক্ষামন্ত্রণালয়ের কাছে নাম পাঠানো হয়, তারপর সেটা যাচাই-বাছাই করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে যায়, তার অনুমতিক্রমে বা তার সিলেকশনের পরে মহামান্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেন।
এই প্রক্রিয়াটা অনেক সময় একটা দীর্ঘসূত্রিতার তৈরি করে। দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অনেক সময় দেখা যায়, এমন ব্যক্তিকে নিয়োগ বা প্রপোসড করা হয়েছে তাদের অনেকেরই রিকোয়ারড কোয়লিফিকেশন থাকে না। এখানে কথা আছে ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগের ব্যাপারে তাদের পিএইচডি ডিগ্রী থাকতে হবে। আর যদি পিএইচডি ডিগ্রী না থাকে তাহলে অন্য যে কোনো উচ্চতর ডিগ্রী থাকলেও হবে। তবে সেই ডিগ্রীতে তাকে প্রথম শ্রেণি প্রাপ্ত হতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ নয়।
আরেকটা সমস্যা হলো, শিক্ষামন্ত্রণালয়ও এই নিয়োগে তাদের পছন্দমাফিক লোক বা তারা যাদেরকে যথাযথ যোগ্যতা সম্পন্ন মনে করে রিকমান্ড করে পাঠায়। ট্রাস্টি বোর্ড সেখানে হয়তো তিন জনের একজন দিয়েছে কিন্তু তারা যে এই তিনজনের একজনকে দিবে, তা নয় তারা এক নম্বরকেই দিবে। যে কারণে দুই নম্বর বা তিন নম্বরে যারা থাকে তারা আশাহত হয়। এসব কারণেই এই নিয়োগ প্রক্রিয়া ধীর লয় প্রক্রিয়াতে হয়ে থাকে।
এটার বিরুদ্ধে ইউজিসি যে সুপারিশটা করেছে, আমি মনে করি এ মোতাবেক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবে এখানে একটা কথা আছে, পাবলিক প্রাইভেট মিলিয়ে দেশে ১৩৫টির উপরে বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগের জন্য যথাযথ যোগ্যতা সম্পন্ন, রেপুটেশন সম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে প্যানেল অফ স্কিল করে পাঠানোটাও একটা কষ্টসাধ্য কাজ হয়ে গেছে।
এটা পুরোপুরি এপ্লাই করতে গেলে অবস্থার যাতে কোনো রকম ব্যতিক্রম না হয় সেটাও লক্ষ্য রাখা উচিত। আমরা শুধু এ্যাডমিনিস্ট্রেটেড দক্ষতার খাতিরে এ্যাকশন নিলাম কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপরে কি ইমপ্যাক্ট হবে, ছাত্রদের উপরে কি ইমপ্যাক্ট হবে, শিক্ষাকার্যক্রম কি ব্যাহত হবে সেগুলোও বিবেচনায় আনা উচিত।
আমাদের হাইয়ার এডুকেশনে প্রাইভেট ইউনিভিার্সিটির কনসেপ্টটাতো ১৯৯২ সাল থেকেই শুরু হয়েছে, খুব বেশি দিনতো আর হয় নি। সুতরাং এদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাস্টি বোর্ডের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হলে, শিক্ষামন্ত্রণালয় দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করলে এবং সর্বোপরি ইউজিসিকে যদি নিয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষমতায়ন করা হয়, তাহলে এই দীর্ঘসূত্রিতা কম হবে।
ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশন ইন্ডিয়াতেও আছে। কিন্তু তারা অনেক পাওয়ারফুল, তারা শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। তারাই পাবলিক ইউিনিভার্সিটির ট্রাস্ট কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। সেখানে ইউজিসি অনেক পাওয়ারফুল। আমাদের এখানে এই নিয়মটা করা হয় না। এজন্য আমাদের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলো নিজেদের মতো করে এই নিয়োগগুলো দিয়ে থাকে।
আমি বলবো না যে সব বিশ্ববিদ্যালয় খারাপ। এতদসত্ত্বেও পঁচিশ-ত্রিশটি বিশ্ববিদ্যালয় ভালভাবে উত্তরণ করেছে ট্রাঞ্জিকশনে এবং তারা ভাল অবস্থানে আছে।
এখানে অর্থনৈতিক দিকটাও প্রণিধানযোগ্য। যেমন ট্রাস্টি বোর্ডের মেম্বারদেরকে পাঁচ কোটি টাকা দিতে হয় এবং অনেক ডেমারেজ দিতে হয়, সেই সঙ্গে নিজস্ব ক্যাম্পাসের জন্য অখন্ড জমি কোথায় পাওয়া যাবে আমি জানি না। কিছু কিছু নিয়ম আছে যেগুলো ভাল কিন্তু সেগুলো প্রয়োগ করতে গেলে অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সেই সব দিক বিবেচনা করে প্রায় সবাই ভালই এগোচ্ছে।
আরেকটু কেয়ারফুল হলে, ট্রাস্টি বোর্ড যদি দেশের কথা চিন্তা করে এবং সরকারের পক্ষ থেকেও যদি যত্ন সহকারে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়, ইউজিসিকে ক্ষমতায়ন করা হয়, যোগ্য ব্যক্তিদেরকে ভাইস চ্যান্সেলর, প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ করা হয়, তাহলে উচ্চ শিক্ষা একটি গ্রেট লুক ফরোয়ার্ড হবে। সূত্রঃ আমাদেরসময়.কম
পরিচিতি: সাবেক চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সাবেক ভিসি, ঢা.বি.