আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা নেতা আতা উল্লাহ এখন মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে এক আতঙ্কের নাম। যদিও সমর্থকদের কাছে তিনি একজন মুক্তিকামী নেতা। যিনি সৌদি আরবের বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে লড়াই করছেন।
অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, তার দলের বেপরোয়া সিদ্ধান্তের কারণে রাখাইনের লাখ লাখ সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবন বিপদের মধ্যে পড়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের জন্য আতা উল্লাহ এখন ‘অভিশাপ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুক্রবার ফ্রি মালয়েশিয়া টুডে অনলাইন আতা উল্লাহ’কে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রিচার্ড হর্সির মতামত তুলে ধরে বলা হয়, ‘আতা উল্লাহ খুবই ক্যারিশমাটিক। সে সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। এমনভাবে কথা বলে যেন রোহিঙ্গাদের কষ্ট তিনি অনুভব করতে পারছেন।’
গেল ২৪ আগস্ট রাখাইনের পুলিশ চেকপোস্টে আতা উল্লাহ’র নির্দেশেই হামলা চালায় আরসা। এরপর সেনাবাহিনী জঙ্গি বিরোধী অভিযানের নামে রোহিঙ্গা নিধন শুরু করলে মিয়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ৪ লাখ ২০ হাজার মানুষ।
গত বছরের অক্টোবরে এক ভিডিও বার্তায় রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন হিসেবে আরসার আত্মপ্রকাশ ঘটে। এসময় দলটির নেতা হিসেবে নিজেকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন আতা উল্লাহ।
সেই সময় মিয়ানমার সীমান্তে নিরাপত্তা বাহিনীর উপর একটি হামলা ঘটনাও ঘটে। বলা হয়, এই বিদ্রোহী সংগঠনই হামলাটি চালিয়েছিল।
শুরুতে এই সংগঠনের কাছে খুব বেশি অস্ত্র ছিল না। দলের সদস্যরা বেশিরভাগ সময় লাঠি ও চাপাতি নিয়েই হামলা চালাত। প্রথম দিকের প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন মুখোশধারী লোক দাঁড়িয়ে আছে আর মাঝে আতা উল্লাহ মিয়ানমার সরকারের মানবতাবিরোধী অপরাধের বর্ণনা দিচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের জন্য কষ্টকর জীবন বেঁছে নিলেও আতা উল্লাহ উঠে এসেছে সৌদি আরবের বিত্তশালী পরিবার থেকে। তার এক আত্মীয় বার্তা সংস্থা এএফপি’কে জানিয়েছিল, আতা উল্লাহ্র বাবা করাচিতে দারুল উলুম মাদ্রাসায় পড়াশোনার পর পরিবারসহ সৌদি আরবে চলে যান। সেখানে তার বাবা শিক্ষকতা শুরু করেন।
এরপর এক বিত্তশালী পরিবারের নজরে আসে আতাউল্লাহ। সেই পরিবারের সন্তানদের পড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয় তাকে। খুব দ্রুতই তাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে যান আতা উল্লাহ।
আতা উল্লা’র সৌদি জীবন সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক আত্মীয় এএফপিকে জানিয়েছেন, ওই পরিবার আতা উল্লাহ্কে এতটাই ভালোবাসত যে পরিবারের আপন বলেই মনে করত।
নিজেও বিলাসি জীবনে ভেসেছিল আতা উল্লাহ.. রাতভর পার্টি, শিকার কিংবা ভ্রমণে যাওয়া নিত্য ব্যাপার ছিল।
কিন্তু ২০১২ সালে রাখাইনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ১ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হলে তার বিবেককে নাড়া দেয়। এরপরই সে সৌদি আরবের বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে রোহিঙ্গাদের সমর্থনে যুদ্ধের জন্য মাঠে নামে।
শুরুতে সৌদি আরব থেকে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে পাকিস্তানে আসে আতা উল্লাহ। এই টাকা দিয়ে শীর্ষ জিহাদিদের কাছ থেকে সে অস্ত্র, যোদ্ধা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল। এমনটাই জানিয়েছে করাচিতে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা জঙ্গিরা।
২০১২ সালে তার সঙ্গে ৩ জঙ্গির সাক্ষাৎ হয়। অস্ত্র ও যোদ্ধা সংগ্রহের জন্য তিনি ইসলামের ঐতিহ্যবাহী লেনদেন ব্যবস্থা হাওয়ালা’র মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করে। ওই জঙ্গির মতে, সেই অর্থের উৎস ছিল সৌদি আরব। সৌদিতে থাকা রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর মানুষও অর্থের জোগান দেয়।
বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে সে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের তালেবান এবং জম্মু-কাশ্মিরের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার কাছ থেকেও সহযোগিতা চায়।
অবশ্য এক সহযোগীর মতে, ‘প্রকাশ্যে ওই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বললেও রাখাইনে তাদের হয়ে যুদ্ধ করতে রাজি হয়নি। উল্টো অস্ত্র বিক্রির অর্থও তারা আত্মসাৎ করে। ফলে আতা উল্লাহ’র অস্ত্র সংগ্রহ কার্যক্রম ব্যর্থ হয়।’
এই বিষয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল তালাত মাসুদের মতামত হচ্ছে, ‘আল-কায়েদার মতো সংগঠনগুলোর মিয়ানমারে জিহাদের ডাক আসলে মুসলিমদের সহানুভূতি অর্জনের জন্য লোক দেখানো প্রচারণা।’
২০১২ সালে পাকিস্তানে আতাউল্লাহকে কাছ থেকে দেখা বেশ কয়েকজন জঙ্গি জানিয়েছে, আতা উল্লাহ পাকিস্তান ছেড়ে যাওয়ার সময় একজন জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিতে পরিণত হন। প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থ এবং অর্থ আত্মসাতের কারণে জঙ্গি সংগঠনগুলোর উপর তার আস্থা নষ্ট হয়ে যায়।
আতা উল্লাহ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের বা আরএসও’সহ রাখাইনের অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠক করে।
আরসার নেতার সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন সূত্র জানায়, রাখাইনের নতুন সহিংসতার পর অনেক জঙ্গি গোষ্ঠীই আতা উল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিতে চাচ্ছে। কিন্তু আতা উল্লাহ তাদের সহযোগিতা নিতে রাজি নয়।
নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলার পর অস্ত্র ও চিকিৎসার খুব প্রয়োজন তাদের ছিলো। কিন্তু সহযোগিতা নেওয়ার জন্য দলের কয়েকজন সহযোগী পরামর্শ দিলেও সে রাজি হয়নি।
আতা উল্লাহ’র আশঙ্কা, এতে করে তাদের মুক্তিকামী আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর মাঝে হারিয়ে যেতে পারে তাদের আসল উদ্দেশ্য।
কিন্তু আরএসও’র পাকিস্তানি প্রতিনিধি নুর হুসেন বার্মির মতে, আরসার উগ্রতার কারণে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা বেড়েছে। আতা উল্লাহ্ সেখানে কাউকে কাজ করতে দেয় না কারণ এতে করে অবস্থান হারানোর ভয় তার আছে।
আর মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ রিচার্ড হর্সির ভাষায়, আতা উল্লাহর বিদ্রোহ রোহিঙ্গাদের হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরসা রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে লড়াই করছে, এমন দাবি গ্রহণযোগ্যভাবে প্রতিষ্ঠা করা খুবই কঠিন। সূত্র : পরিবর্তন