কক্সবাজারের কুতুপালং বাজারের রাস্তার পশ্চিম পাশে পরিত্যক্ত জায়গায় ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। যত্রতত্র মলমূত্রের দুর্গন্ধ।
এর পাশেই ১০ ফুট লম্বা ও ৭ ফুট চওড়া জায়গায় দুটি তাঁবু খাটিয়েছে রোহিঙ্গারা। তাঁবু বলতে ওপরে এবং তিন পাশে পলিথিন ঘেরা।
গত শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে দেখা গেল, একটি তাঁবুর সামনের খোলা অংশে বসে দুই ব্যক্তি প্রস্রাব করছে। কয়েক গজের মধ্যে মাটিতে বিছানো পলিথিনে এলোপাতাড়ি পাঁচ শিশুসন্তান নিয়ে শুয়ে আছেন তাদের মা-বাবা।
লোকজনের শব্দ শুনে ওই শিশুদের বাবা সাব্বির আহমদ (৩০) ও মা আনোয়ারা বেগম (২৫) ঘুম থেকে উঠে যান। পরিচয় না জেনেই আনোয়ারা তাঁর নিজস্ব ভাষায় বলতে থাকেন, যার বাংলা, ‘একটা স্লিপ দেন না। এখানে তো আর থাকতে পারছি না। কতজনকে বলি কেউ তো নাম লিখে না?’
পরে পরিচয় দেওয়ার পর সাব্বির বলেন, ‘সারা দিন ত্রাণের জন্য ঘোরাঘুরি করে বাচ্চারা দুর্বল হয়ে গেছে। রাতে শুধু একটু ঘুমাই আমরা।
ওখানে (মিয়ানমারের রাখাইনের মংডু) তো রাতেও ঘুমাতে পারিনি। এখানে দুর্গন্ধের মধ্যে থাকলেও একটু করে হলেও ঘুমাতে পারছি। ’
সাব্বিরের কথা শেষ হতেই আনোয়ারা আবার বলেন, ‘এদিকে (তাঁবুর সামনের খোলা অংশ) গাড়ি যাওয়ার সময় ধুলাবালি ঢুকছে। বৃষ্টি হলে পানি জমে থাকে। মশারি নেই। তাই এভাবেই ঘুমাতে হয়। ’
সাব্বির ও আনোয়ারা জানান, গত বুধবার মংডুর ছাদুলাচর থেকে তাঁরা এখানে এসেছেন। মিয়ানমারের স্থানীয় মুদ্রা ৫০ হাজার কিয়াত আনতে পেরেছিলেন। তা ভাঙিয়ে বাংলাদেশি টাকা পেয়েছেন দুই হাজার ৫০০। তার মধ্যে দুই হাজার টাকা ভাড়ায় এই ঝুপড়িতে থাকছেন। এই মাসের টাকা অগ্রিম দিতে হয়েছে।
টাকা দিতে না পারলে আগামী মাসে এই জায়গা ছাড়তে হবে। এক বছর দুই মাস থেকে সাত বছর বয়সের পাঁচ শিশুসন্তান নিয়ে কী করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না।
সাব্বির ও আনোয়ারা দম্পতির সঙ্গে কথা বলতে বলতে আশপাশ থেকে এগিয়ে এলেন আরো কয়েকজন। তাঁদের একজন সৈয়দ আহমদ বলেন, ‘আমার ওখানে (তাঁবু) চলেন না। আমার ও বোনের পরিবারসহ আমরা এক কক্ষে ১৪ জন থাকি। সবাই একসঙ্গে রাতে ঘুমাতে না পারায় আমি ও আমার দুই ভাই দুপুরে ঘুমাই। রাতে ঘুমায় ১১ জন। এভাবে থাকছি আজকে ১৭ দিন। ’
সৈয়দ আহমদ বলেন, ‘এখানে আসার পর প্রথম তিন দিন থাকার জায়গা না পেয়ে রাস্তার পাশে গাছের নিছে ঘুমিয়েছি। একদিন রাতে কেউই ঘুমাতে পারিনি। সবাই বৃষ্টিতে ভিজে রাত কাটিয়েছি। ’
এরপর রাত ১টার দিকে কুতুপালং বাজার পেরিয়ে একটি বটগাছের পাশে পশ্চিমে টিলার নিচে আরেকটি তাঁবুতে গিয়ে দেখা যায়, ওপরে ছাউনি (আংশিক) ও এক পাশে পলিথিন রয়েছে। আর দুই পাশে ছেঁড়া কাপড়চোপড় দিয়ে বেড়া দেওয়া। অন্ধকারাচ্ছন্ন এ তাঁবুতে শিশুর কান্না শুনে গিয়ে জানা যায়, তিন মাসের ওই শিশুর নাম মো. আয়াছ। ঠাণ্ডা বাতাসে ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠেছে।
ওই তাঁবুতে দেখা গেল, সাত সন্তান নিয়ে শুয়ে আছেন মা আম্বিয়া খাতুন। তাদের শরীর অর্ধেক পলিথিনে, অর্ধেক মাটিতে। তবে আয়াছসহ তার মা ছোট্ট একটি মশারির ভেতরে। বাকি ছেলে-মেয়েরা মশারির বাইরে।
এদিকে উখিয়ার বালুখালী থেকে ট্যাংখালীর দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। উখিয়া কলেজ গেট থেকে কুতুপালং বাজার হয়ে বালুখালী পর্যন্ত সড়কপথ প্রায় চার কিলোমিটার। সব মিলে এই সাত কিলোমিটার সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাতে দেখা গেছে, কোথাও সড়কের মোড়ে মোড়ে ও গাছের নিচে, দোকানপাটের সামনে বসে আসে রোহিঙ্গারা।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ত্রাণ হিসেবে বেশির ভাগই খাদ্যসামগ্রী পাচ্ছে, কিন্তু মাথা গোঁজার ঠাঁই হচ্ছে না। বাসস্থানের অভাবে চরম মানবেতর জীবন যাপন করছে। কখনো রোদে পুড়ে আবার কখনো বৃষ্টিতে ভিজেই কাটছে তাদের দিন-রাত। দিনে কোনো মতে এদিক-ওদিক থাকলেও রাতে শুরু হয় হাহাকার।
এ ছাড়া শুক্রবার রাত ১০টার দিকে কুতুপালং বাজার থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে খাংখালী বাজারের পাশে কয়েকটি গাছের নিচে ১২-১৪ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে বসে থাকতে দেখা গেছে। তাদের কয়েকজনের কোলে শিশুও ছিল। শিশুরা তাদের মায়ের কোলে ঘুমালেও মা-বাবারা জেগে ছিলেন।
ওই সময় জমিলা পরিচয় দিয়ে এক নারী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘কোথায় থাকব? থাকার কোনো জায়গা নেই। পাঁচ দিন ওখানে (কুতুপালং) রাস্তার পাশে একটি তাঁবুর সামনে ছিলাম। কালকে (বৃহস্পতিবার সকালে) এখানে এসেছি। বাবাহারা বাচ্চাকে যদি রাতে কেউ নিয়ে যায় তাই ঘুমাই না। দিনে এখানে (গাছতলা) বসে বসে ঘুমাই। ’
তখন তাঁর পাশে থাকা রহিমা বেগম বলেন, ‘বাড়ি (রাখাইনের ভুষিদং) থেকে আসার সময় বৃষ্টি ছিল। তখন হাতে একটি ছাতা ছিল। ওই ছাতার নিচে এখন ইটের ওপর একটি কাপড় বিছিয়ে বাচ্চাকে রাতে ঘুম পাড়াই। কী করব, আমার কাছে কোনো টাকা-পয়সা নেই। কোথাও থাকতে পারছি না। ’
এদিকে গতকাল শনিবার দুপুর ১টার দিকে বালুখালী থেকে কুতুপালং আসার পথে দেখা গেল, রাস্তায় একটি ত্রাণের গাড়ি দেখে দৌড়ে যায় ১৮-২০ জন রোহিঙ্গা। গাড়ি থেকে নেমে তিন যুবক মুড়ি-চিড়ার প্যাকেট দিল।
দুই প্যাকেট চিড়া-মুড়ি নিয়ে তাঁবুতে যাওয়ার পথে এক রোহিঙ্গা আরেকজনকে বলেন, ‘এইগুলো তো আমরা কালকেও পেয়েছি। মনে করেছিলাম এখানে পলিথিন অথবা ত্রিপল দেবে। তা পেলে আরেকটি তাঁবু বাঁধতে পারতাম। আমাদের তাঁবুতে ১৫ জন থাকি। দুই পরিবার একসঙ্গে। সবাই ঘুমাতে পারি না। তাই আরেকটি তাঁবু দরকার। ’
এখানে আশ্রয় নেওয়া অনেক রোহিঙ্গা খাবার পেলেও এখন তাদের প্রধান সমস্যা বাসস্থান সংকট। কেননা সবার ভাগ্যে এখনো তাঁবু অথবা অস্থায়ী বসতি জোটেনি।কালের কন্ঠ