আগামী সপ্তাহে তেহরান সফর করবেন তুরস্কের উঁচু পর্যায়ের সামরিক একটি প্রতিনিধিদল। চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল হুলুশি আকার নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলের এই সফর অনুষ্ঠিত হবে। ইরানিয়ান সেনাবাহিনী এই তথ্য জানিয়েছে।


ইরানের সামরিক বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ বাকেরির (সি) আঙ্কারা সফরের প্রেক্ষিতে এই সফর অনুষ্ঠিত হবে। তুরস্কের সফরকারী দল প্রত্যাশা করছে- আঙ্কারা সফরকালীন ইরানের প্রতিনিধিদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ও চুক্তি বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া হবে।


উল্লেখ্য ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের পর জেনারেল বাকেরির তিনদিনের তুরস্ক সফরই ছিল কোনো ইরানি সেনা প্রধানের প্রথম তুরস্ক সফর। তার সঙ্গে ছিল একটি উঁচু পর্যায়ের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিনিধিদল।

প্রতিনিধি দল প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোগানের সাথেও সাক্ষাৎ করেছিল। সফরের সময় বাকেরি তুর্কি কর্মকর্তাদের সাথে যৌথ প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা, সামরিক শিক্ষাখাতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও শিক্ষার্থী বিনিময় এবং সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তথ্য বিনিময়ের মাত্রা বাড়াতে সম্মত হয়েছিলেন।
সূত্র: মিডল ইস্ট মনিটর



ইরান-তুরস্কের হুমকিকেও অটল ইরাকি কুর্দিরা
প্রতিবেশীদের হুমকি উপেক্ষা করে ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় কুর্দি অধ্যুষিত স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তান প্রদেশে স্বাধীনতার প্রশ্নে গতকাল গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। কুর্দিস্তান রিজিওনাল গভর্নমেন্টের (কেআরজি) এ গণভোটের আয়োজন করা হয়।

স্থানীয় সময় সকাল ৮টায় ভোটকেন্দ্রগুলোর দরজা খোলা হয় এবং বিকেল ৬টা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ করা হয়। ভোট শেষ হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হবে বলে জানানো হয়।


গণভোটে ‘হ্যাঁ’ সহজেই জয়যুক্ত হবে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। স্বাধীনতার পক্ষে গণরায় এলেই কুর্দিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করবে এমন নয়। এই রায়ে কেআরজির নেতা মাসুদ বারজানি স্বাধীনতার প্রশ্নে বাগদাদ ও প্রতিবেশী অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে দেনদরবার শুরু করতে পারবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।


কেআরজির রাজধানী ইরবিলের এক স্কুলে পুরুষ ভোটারদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা রিজগার বলেন, ‘এ দিনটির জন্য আমরা ১০০ বছর ধরে অপেক্ষা করেছি। আল্লাহর সাহায্যে আমরা নিজেদের জন্য একটি রাষ্ট্র চাই। আজ কুর্দিদের উৎসবের দিন। ইনশাআল্লাহ আমরা বলব হ্যাঁ, প্রিয় কুর্দিস্তানের জন্য হ্যাঁ।’

কুর্দি হোক বা না হোক, কুর্দিস্তানের রেজিস্ট্রিকৃত সব বাসিন্দার জন্য ভোট উন্মুক্ত। উত্তর ইরাকের কুর্দি-নিয়ন্ত্রিত এলাকার ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী সব মানুষই ভোট দিতে পারবে বলে জানিয়েছিল গণভোট কমিশন। কমিশনের হিসাবে এলাকাটির মোট ভোটারের সংখ্যা ৫২ লাখ। এদের মধ্যে প্রবাসী ভোটাররাও রয়েছেন।


ব্যালট পেপারে কুর্দি, তুর্কি, আরবি ও অ্যাসিরীয় ভাষায় ভোটারদের একটি মাত্র প্রশ্ন করা হয়েছে। প্রশ্নে বলা হয়েছে, ‘কুর্দিস্তান অঞ্চল ও এর বাইরের অন্যান্য কুর্দিস্তানি এলাকা নিয়ে একটি স্বাধীন দেশ হোক তা কি চান আপনি?’ এর উত্তরে হ্যাঁ অথবা না বিকল্প রাখা হয়েছে ব্যালট পেপারে, ভোটার যে উত্তরটি বেছে নেবেন তাতে টিক চিহ্ন দেবেন।


এই গণভোটের কারণে কুর্দিস্তানের সাথে বাগদাদ ও ইরাকের প্রতিবেশী শক্তিশালী রাষ্ট্র ইরান ও তুরস্কের বিবাদ শুরু হতে পারে আশঙ্কায় নির্বাচন বাতিল করার জন্য বারজানির ওপর প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ ছিল। ওই চাপ উপেক্ষা করেই সেখানে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।

 

এই গণভোটের কারণে রোববার ইরান কুর্দিস্তানমুখী এবং কুর্দিস্তান থেকে সব ধরনের বিমান চলাচল বন্ধ করার ঘোষণা দেয়। অন্য দিকে সব বিদেশী পক্ষকে কুর্দিস্তানের সাথে সরাসরি জ্বালানি তেল বাণিজ্য না করার অনুরোধ জানিয়েছে বাগদাদ এবং কেআরজির কাছে তাদের সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ইরান, তুরস্ক ও সিরিয়ার সাথে থাকা সব সীমান্ত চৌকির নিয়ন্ত্রণ বাগদাদের হাতে তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছে।


তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম বলেছেন, ‘দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্তে কোনো নতুন গঠন ও অবস্থা পরিবর্তনকে কখনোই বরদাশত করবে না তুরস্ক।

এ গণভোটের কোনো মূল্য নেই তাদের কাছে।’ কিন্তু ইরবিলে ভোট দিতে লাইনে অপেক্ষমাণ তালাত বলেন, ‘খারাপ পরিস্থিতি দেখেছি আমরা, অবিচার দেখেছি, হত্যাকাণ্ড ও অবরোধও দেখেছি। ইনশা আল্লাহ, আমরা বিশ্বের অন্যান্য লোকজনের মতো হতে চাই। আমরা স্বাধীনতা চাই এবং একটি রাষ্ট্র চাই।’


প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর ওসমানি সালতানাতের বিশাল অংশ দখল করে নিয়েছিল ব্র্রিটেন ও ফ্রান্স। এরপর তারা চলে যাওয়ার পর কুর্দিরাই সবচেয়ে বড় নৃগোষ্ঠী যাদের কোনো রাষ্ট্র ছাড়াই রেখে যাওয়া হয়েছিল।

প্রায় তিন কোটি কুর্দিদের অঞ্চলটি বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্র্রের অংশ করে দেয়া হয়। এদের মধ্যে ইরাক, ইরান, তুরস্ক ও সিরিয়ায়ই সবচেয়ে বেশি কুর্দি অঞ্চল পড়েছে।

হামলা চালাবে ইরাক-তুরস্ক যৌথ বাহিনী!
ইরাকে আধা-স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার ওপর আয়োজিত গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ইরাক ও তুরস্কের সেনারা দুই দেশের অভিন্ন সীমান্তে বড় ধরনের যৌথ সামরিক মহড়া শুরু করেছে। ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকার এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ উপেক্ষা করে কুর্দি নেতারা সোমবার এ গণভোটের আয়োজন করেন।


ইরাকের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, দেশের সামরিক বাহিনীর চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওসমান আল-গানিম ইরাক ও তুরস্কের অভিন্ন সীমান্তে বিশাল এ মহড়ার কথা ঘোষণা করেন। ইরাকের আরবি ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল আস-সুমারিয়া এ খবর দিয়েছে। গণভোটকে কেন্দ্র করে ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকার ও কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে দেশটির জাতীয় সংসদের সদস্যরা বিরোধপূর্ণ কুর্দি এলাকাগুলোতে সেনা মোতায়েনের দাবি করেছিলেন।

এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইরাক ও তুরস্কের সেনারা যৌথ মহড়া শুরু করল। এদিকে ইরাকের কুর্দিস্তানে গণভোটের পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছেন সীমান্তবর্তী দেশ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান। স্থানীয় সময় সোমবার ইস্তাম্বুলে দেয়া এক বক্তব্যে এরদোগান এ হুমকি দেন।


এরদোগান বলেন, ‘যেকোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে ইরাকের সীমান্তে আমাদের সশস্ত্রবাহিনী তৈরি আছে।’ তিনি বলেন, এই গণভোটের পরিপ্রেক্ষিতে কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের (কেআরজি) তেল রফতানি আটকে দিতে পারে তুরস্ক। ‘আমরা তুরস্ক থেকে কাউকে বা কোনো কিছু ইরাকে প্রবেশ করতে দেবো না।

আমরা সীমান্ত বন্ধ করে দেবো। সীমান্ত দিয়ে কোনো কিছুই যেতে পারবে না।’ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, ইরাকের সাথে তুরস্কের একমাত্র স্থলসীমান্ত হাবুরের প্রবেশ-প্রস্থান বন্ধ করে দেয়া হবে। এরপর দেখি কোন্ পথ দিয়ে তেল পাঠায়, কাদের কাছে তেল বিক্রি করে তারা। কপাট আমাদের হাতে। আমরা আটকানোর সাথে সাথে এটা (রফতানি) বন্ধ হয়ে যাবে।


তুরস্ক থেকে কুর্দি সীমান্ত অভিমুখে যান চললেও উল্টো পথে চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ইরাকের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা তুর্কি সেনাবাহিনীর সাথে সীমান্তে যৌথভাবে কুর্দি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে। তুরস্কের এক সম্প্রচার কর্মকর্তা জানান, গণভোটের পরপরই আঙ্কারা রুদাও টেলিভিশনের স্যাটেলাইট চ্যানেল তার্কস্যাট বন্ধ করে দিয়েছে।

ভোটের আগে যুক্তরাষ্ট্রও সতর্ক করে বলেছিল, বিবদমান অঞ্চলে হওয়া গণভোট অস্থিতিশীলতা উসকে দিতে পারে। সোমবার পেন্টাগনের মুখপাত্র কর্নেল রবার্ট ম্যানিং সাংবাদিকদের বলেন, উত্তর ইরাকের গণভোট আইএসবিরোধী যুদ্ধের মনোযোগ সরিয়ে নেবে না বলে আশা করছেন তারা। ইরাককেই কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলের সমস্যার সমাধান করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।


এদিকে সোমবার ইরাকি কুর্দিস্তানে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটের ফলে তুরস্ক, ইরান ও সিরিয়াসহ অনেক দেশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বৃহত্তর কুর্দিস্তান আন্দোলনের আশঙ্কায় নতুন করে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।


ইরাকের উত্তরে কুর্দিস্তান এলাকা সেই সাদ্দাম হোসেনের আমল থেকেই স্বায়ত্তশাসনে অভ্যস্ত। এবার পাকাপাকিভাবে স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র ঘোষণা করতে চায় কুর্দি নেতৃত্ব। সেই লক্ষ্যে গণভোটে বিপুলসংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীন কুর্দিস্তানের পক্ষে রায় দেবেন বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। তবে এই গণভোট কার্যকর করার কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই।

ইরাকে কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের প্রধান মাসুদ বারজানি এই গণভোটকে হাতিয়ার করে ইরাকের সরকারের সঙ্গে স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করবেন বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। বারজানি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, গণভোটে ইতিবাচক রায় পেলে বাগদাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই তিনি সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার চেষ্টা করবেন।


কুর্দি এলাকার এক টেলিভিশন চ্যানেলের সূত্র অনুযায়ী প্রায় ৭৮ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। কুর্দিস্তানের বাইরে ইরাকের উত্তরে কিছু অংশেও এই গণভোট আয়োজন করা হয়েছে। আইএসের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কারণে সেসব এলাকা আপাতত কুর্দি বাহিনীর দখলে।


কুর্দিদের একটা বড় অংশ স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিলেও আরব ও তুর্কমেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এমন পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে। স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেয়ার জন্য তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

এই গণভোটকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক মহলেও বিপুল তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। কারণ, ইরাকি কুর্দিস্তান সত্যি স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলে ইরান, তুরস্ক ও সিরিয়াসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে ছড়িয়ে থাকা কুর্দি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোও একে একে সেই রাষ্ট্রে যোগ দিতে পারে।

 


Comments