জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলের ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন খেতাব বাতিল হয়েছে।
বিবাহিত হওয়া সত্বেও নিজেকে অবিবাহিত কুমারী দাবি করে মিথ্যা তথ্য দেয়ার পর তীব্র সমালোচনার মুখে প্রতিযোগিতাটির আয়োজক প্রতিষ্ঠান অন্তর শোবিজ বুধবার বিকালে রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এভ্রিলকে অযোগ্য ঘোষণা করে নতুন মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ঘোষণা করেছে জেসিয়া ইসলামকে।
পরে জেসিয়ার মাথায় মুকুট পরিয়ে দেন গ্র্যান্ড ফিনালেতে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল। প্রথম রানারআপ হয়েছেন ফাতেমা তুজ জোহরা, যৌথভাবে দ্বিতীয় রানারআপ হন রুকাইয়া জাহান চমক ও সঞ্চিতা দত্ত।
অনুষ্ঠানে বিচারকদের মধ্যে ছিলেন অভিনেত্রী শম্পা রেজা, আলোকচিত্রী চঞ্চল মাহমুদ।
এ ছাড়া সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন আয়োজক অন্তর শোবিজের চেয়ারম্যান স্বপন চৌধুরী, সহ-আয়োজক ওমিকন এন্টারটেইনমেন্টের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান ও টাইটেল স্পন্সর লাভেলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. একরামুল হক।
বিতর্ক এড়াতে গতকাল বিচারক ও সাংবাদিকদের সামনে রেখেই 'স্বচ্ছ' ফল ঘোষণা করেন আয়োজকরা। উক্ত সংবাদ সম্মেলনে জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল ছাড়া বাকি ৯ প্রতিযোগীকে ডাকা হয়েছিল। প্রতিযোগিতায় প্রথম রানার আপ হওয়া জেসিয়া ইসলামই হলেন ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’।
আগামী ১৮ নভেম্বর চীনের সানিয়া শহরে অনুষ্ঠিত হবে ৬৭তম মিস ওয়ার্ল্ডের জমকালো আসর। এবার বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১১৩ সুন্দরী এ প্রতিযোগিতায় সেরার মুকুটের জন্য লড়বেন। বর্তমান বিশ্বসুন্দরী স্টেফানি দেল ভালে নতুন মিস ওয়ার্ল্ডের মাথায় মুকুট পরিয়ে দেবেন।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর বসুন্ধরা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটির নবরাত্রি মিলনায়তনে ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ হিসেবে জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলের নাম ঘোষণা করা হয়। তবে বিচারকরা দাবি করেন, এভ্রিল মিস ওয়ার্ল্ড হননি।
বিচারকদের নম্বরের তোয়াক্কা না করেই আয়োজকরা নিজেদের পছন্দে তাকে মিস ওয়ার্ল্ড ঘোষণা করে। জেসিয়াকে করা হয় দ্বিতীয় রানারআপ।
প্রথমে শীর্ষ ১০ প্রতিযোগীর মধ্যে জান্নাতুল সুমাইয়া হিমিকে বিজয়ী ঘোষণা করার কিছুক্ষণের মধ্যেই আয়োজকরা জানান, তিনি হয়েছেন দ্বিতীয় রানারআপ! পরে জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলকে বিজয়ী ঘোষণা করেন তারা।
এরপর থেকেই অনুষ্ঠানটিকে ঘিরে আলোচনা-সমালোচনায় মুখর বিনোদন অঙ্গন। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এভ্রিলের বিয়ের ছবি, ভিডিও, সাবেক স্বামীর সাক্ষাৎকার ছড়িয়ে পড়লে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন আয়োজকরা।
ফেসবুক লাইভে মঙ্গলবার বিকেলে জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল ‘বিবাহিত ও ডিভোর্সি’ বলে স্বীকার করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এভ্রিল যেহেতু তথ্য গোপন করেছেন তাই শাস্তিস্বরূপ তাকে বাদ দেয়া হবে। মূল আয়োজনকারীরা চান না একজন মিথ্যাবাদী একটি দেশের প্রতিনিধি হয়ে আসুক।
এদিকে জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলকে নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা-তর্ক-বিতর্ক। কে এই এভ্রিল? কি তার অতীত-বর্তমান?
তার ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন খেতাব অর্জনের রহস্য কি ? এসব নিয়ে অনুসন্ধানে নেমে সাংবাদিকদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে সিনেমার মতো গল্প। আমেনা থেকে এভ্রিল হওয়ার গল্প।
এভ্রিলের প্রকৃত নাম আমিনা। ১৯৯০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আমেনার জন্ম চট্টগ্রামের চন্দনাইশের সেবন্দী গ্রামের একটি দরিদ্র কৃষক পরিবারে। তার বাবা তাহের মিয়া। তারা দুই ভাই, দুই বোন। চন্দনাইশ বড়মা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই বিয়ের পিড়িতে বসে জান্নাতুল নাঈম আমেনা।
স্বামী চন্দনাইশ বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী সুদর্শন মনজুর উদ্দিন রানা। বিয়ে হয় ২০১৩ সালের ১১ জুন খুব ঘটা করে। বিয়ের দেনমোহর ছিল আট লাখ টাকা। সুখেই চলছিল তাদের সংসার। তখন দুই মাসের অন্ত:সত্বা আমিনা। আমিনার শ্বশুরালয়-পিত্রালয়ের সবাই খুশি।
ইতিমধ্যে হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যান জান্নাতুল নাঈম আমেনা। কয়েকদিন পর তার বাবা-মা জানতে পারেন-স্থানীয় এক যুবকের প্রেমে পড়ে তার হাত ধরে কক্সবাজার চলে গেছে।
আমেনার স্বামী মনজুর উদ্দিন রানা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিয়ের দুই মাস পর আমিনার বাবা আমাকে ফোন দিয়ে জানালো আমেনাকে পাচ্ছি না। সে কী কারণে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে তা জানি না। তার কি কোনো মাথায় সমস্যা আছে? তাও বুঝতে পারছি না। ও পালিয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে তাকে আমি ডিভোর্স দিয়েছি। চিটাগাং লালদীঘির পাড়ে ফৌজিয়া হোটেলে আমাদের ডিভোর্স হয়।
ও একদিন ফোন দিয়ে আমাকে ডিভোর্স দাও, নইলে আমি তোমাকে ডিভোর্স দেব। ডিভোর্সের জন্য আমি এক সপ্তাহ অপেক্ষা করেছি। পরে জান্নাতুলের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে দুই পক্ষের সমঝোতায় ২০১৩ সালের ১১ জুন কাজির উপস্থিতিতে জান্নাতুল এবং আমি সই করে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটাই। বিয়ের দেনমোহরের টাকা আমি দিয়ে দেই।
আমি তাকে বলেছিলাম -আমাদের সন্তানটা নষ্ট করো না আমিনা। কিন্তু আমিনা আমার কথা শোনেনি। এর পর জানা যায়, আমিনা ডিভোর্সের টাকা নিয়ে তার এক বয়ফ্রেন্ডের সাথে চট্রগ্রাম শহরে বসবাস শুরু করে। তার বাবা আমিনাকে ঘরে ফিরিয়ে আনার জন্য অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
আমিনার বাবা তাহের মিয়া জানিয়েছেন, ‘আমি মেয়েকে উচ্ছৃংখল পথ থেকে ফেরানোর অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। সে খারাপ হয়ে যাওয়ার পর তাকে এখন মেয়ে বলে স্বীকার করি না। তার ভাল বা মন্দ কোনো কাজের দায়ভার আমি কোনোদিনই নেব না। এক সময় আমেনা নামে আমার একটা মেয়ে ছিল এখন সে মারা গেছে।’
আমিনাদের ৫নং বরমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘তার নাম জান্নাতুল নাঈম আমিনা। এলাকায় তার বিয়ে হয়েছিল ভাল একটি ছেলের সঙ্গে। তবে আমিনা সেই সংসার বেশিদিন করেনি।
এদিকে জানা যায়, চট্টগ্রামে থেকে ঢাকায় কিছু ব্যবসায়ীর সাথে তার যোগাযোগ বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকায় এসে জান্নাতুল নাঈম আমেনা হয়ে যান ’জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল’।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার প্রসঙ্গে এভ্রিল জানান, তিনি অল্প বয়সেই মোটরবাইক চালানো শেখেন। এরপর ধীরে ধীরে একে শখে পরিণত হয়। এ যানকে ঘিরেই চলতে থাকে তার নানা কসরত। যা সে ফেসবুকে আপলোড করতে থাকে নিয়মিত। বাড়তে থাকে ফ্যান-ফলোয়ার।
অনেকের নজর কাড়ে তাতে। নজর পড়ে ইয়ামাহা কোম্পানির। বাংলাদেশের হাইস্পিড লেডি বাইক রাইডার হিসেবেও পরিচিতি পান তিনি। ঢাকায় জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল বিভিন্ন আড্ডায় এবং বন্ধুমহলে তাকে ‘মাফিয়া গার্ল’ হিসেবেই অভিহিত করা হয়। মোটরসাইকেল নিয়ে বিভিন্ন নৈপুণ্য দেখাতে পারদর্শী এভ্রিল ইয়ামাহার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়েছেন।
এদিকে সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলে এভ্রিল তাতে অংশ নেন। ২৫ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে সে ছিল একজন। সেখান থেকে নানা পথ-ঘাট উৎরে পৌঁছে যান শীর্ষ দশে।
সেখানে বিচারকদের রায়ে এই এভ্রিল চ্যাম্পিয়ন না হলেও আয়োজক প্রতিষ্ঠানটি চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে। তবে সব চলছিল ভালোই। হঠাৎ বিগড়ে বসেন কয়েকজন বিচারক। তারা বলেন আমাদের বিচার মানেনি আয়োজকরা। শুরু হয় বিতর্ক। পরে বেরিয়ে আসে এই এভ্রিলের আদ্যোপান্ত।
নিজের অতীত গোপন করে এভ্রিল পৌঁছে গেছেন সুন্দরী প্রতিযোগিতায় সেরার আসনে। বিয়ে গোপন করে, বয়স গোপন করে তিনি নিজেকে আড়াল করতে চেয়েছিলেন। হলফ নামায় তিনি বলেছেন, তিনি অবিবাহিত, ঢাকায় নিজেদের বাড়ি-গাড়ি, বাবা থাকেন সিঙ্গাপুর, বড় ভাইও বড় ব্যবসায়ী।
শেষমেষ সামাল দিতে পারেননি তিনি। তবে এখন কানাঘুষা চলছে এই ইভেন্টের সাথে সংশ্লিস্ট কারো কারো সাথে এভ্রিলের অনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে।
এদিকে এভ্রিল দাবি করেছেন, তার যখন বিয়ে হয় তখন তার বয়স ১৬ ছিল। জোর করে বিয়ে দেয়ায় বিয়ের রাতেই তিনি পালিয়ে যান। অথচ কাবিনে লেখা তখন তার বয়স ২৩ বছর। বিয়ের ভিডিও তে দেখা যাচ্ছে-জাকজমক করে, বিয়ে হচ্ছে। বিয়েতে উচ্ছল দেখা যাচ্ছে আমিনাকে।
এভ্রিলকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করলেন ‘লভেলো’ চেয়ারম্যান
‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’র মুকুট হারানো জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলকে খালি হাতে ফিরতে দেয়নি এই প্রতিযোগিতার টাইটেল স্পন্সর ‘লভেলো’ চেয়ারম্যান এমদাদ হক। তিনি প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করেছেন এভ্রিলকে। বুধবার হোটেল ওয়েস্টিনে এক অনুষ্ঠানে এভ্রিল মুকুট হারান। আবার সেই অনুষ্ঠানেই এভ্রিলকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ঘোষণা দেন এমদাদ।