যে আসনটি ঘিরে সব সময়ই চলে রাজনীতির জটিল সমীকরণ, তার নাম পিরোজপুর-১। ইন্দুরকানী-পিরোজপুর সদর এবং নাজিরপুর উপজেলা নিয়ে ছিল আসনটি।

অনেকে বলছেন, এ আসনে ফ্যাক্টর ছিলেন যুদ্ধাপরাধ মামলায় আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা ইন্দুরকানীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।

সাঈদীর অনুপস্থিতিতে এখন প্রার্থী হতে পারেন তার পরিবারের কেউ।

বিগত জাতীয় নির্বাচনের আগে কাছের ইন্দুরকানীকে ঠেলে দেয়া হয় বিশাল কচা নদীর ওপার পিরোজপুর-২-এ। টেনে আনা হয় দূরের নেছারাবাদ উপজেলাকে। এ যোগ-বিয়োগের নেপথ্যে রয়েছে অনেক বিষয়।

ইন্দুরকানীর ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৫৫ হাজার। এতে বিপত্তি দূর না হয়ে বরং রাজনৈতিক জটিলতা বেড়েছে। সাঈদীর পরিবারকে নিয়ে ভয় ছড়িয়ে পড়েছে পিরোজপুর-২-এ। সঙ্গে যোগ হয়েছে মনোনয়ন নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব।

পিরোজপুর সদর-নাজিরপুর আর নেছারাবাদ উপজেলা নিয়ে গঠিত পিরোজপুর-১ আসনে রয়েছে ২টি পৌরসভা ও ২৬টি ইউনিয়ন। ভোটারের সংখ্যা ৪ লাখ ২ হাজার ১০৮।

এত বিপুলসংখ্যক ভোটারের নির্বাচনী এলাকা পুরো দক্ষিণে বিরল। এ আসনে কোনো দলেরই একক আধিপত্য ছিল না কখনও।

১৯৯১ সালে এখানে জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগের প্রয়াত সুধাংশু শেখর হালদার। ’৯৬ সালে তাকে হারিয়ে জয়ী হন জামায়াতের দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। ২০০১ সালেও আসনটি থাকে সাঈদীর দখলে।

২০০৮ সালে মনোনয়ন দেয়া হয় মহাজোটের জাতীয় পার্টির নেতা মোস্তফা জামাল হায়দারকে। দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট যুদ্ধে নামেন আওয়ামী লীগ নেতা একেএমএ আউয়াল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাঈদীকে পরাজিত করে এমপি হন তিনি।

পরে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তাকেই মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ এবং জয়ী হন। সাঈদীকে হারানোয় আউয়ালকে নিয়ে তোলপাড় হলেও কিছুদিনের মধ্যেই পাল্টে যায় সেই পরিস্থিতি। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে।

নিজের ভাইদের সঙ্গেও বিরোধে জড়ান এমপি আউয়াল। সহোদর ৩ ভাই পিরোজপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান খালেক, পিরোজপুর পৌরসভার মেয়র হাবিবুর রহমান মালেক এবং জেলা বাস মালিক সমিতি ও চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মহিউদ্দিন মহারাজ প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেন এমপি আউয়ালের।

সংবাদ সম্মেলন করে আউয়ালের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস-দুর্নীতির অভিযোগ আনার পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে জেলাজুড়ে শক্ত বলয় গড়ে তোলেন এ তিন ভাই।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মনোনয়নের আশায় মাঠে নামেন সেখানকার অন্তত হাফ ডজন আওয়ামী লীগ নেতা। সেই সঙ্গে দলেও দেখা দেয় বিভক্তি। ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ নিয়ে দফায় দফায় সংবাদপত্রের শিরোনাম হতে থাকেন এমপি আউয়াল ও পিরোজপুর আওয়ামী লীগ।

জটিল এ পরিস্থিতিতে ২২ সেপ্টেম্বর পিরোজপুরে অনুষ্ঠিত হয় জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা। উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক চিফ হুইপ সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এমপি বাহাউদ্দিন নাসিমসহ অন্য কেন্দ্রীয় নেতারা। বেশ কয়েক ঘণ্টা বৈঠকের পর তারা এমপি আউয়ালের সঙ্গে ভাইদের বিরোধ মিটমাট করে দেন। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে এলাকায়।

কথা হয় এমপি আউয়ালের ভাই পিরোজপুর পৌরসভার মেয়র হাবিবুর রহমান মালেকের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধাচরণ করার শিক্ষা পাইনি। তাই বিরোধ মিটিয়ে ফেলেছি। তবে আগামী নির্বাচনে দলের কাছে মনোনয়ন চাইব। নেত্রী যদি মনোনয়ন দেন, তাহলে ইনশাআল্লাহ দলকে বিজয় উপহার দেব।’

এমপি আউয়ালও তো মনোনয়ন চাইবেন, সেক্ষেত্রে জটিলতা বাধবে কিনা? জবাবে তিনি বলেন, ‘দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষে ভোটযুদ্ধে নামব। জটিলতার কারণ দেখছি না।’

জানতে চাইলে এমপি আউয়াল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে জানপ্রাণ দিয়ে কাজ করছি। দল নিশ্চয়ই মূল্যায়ন করবে।’

মনোনয়ন তালিকায় আরও যারা রয়েছেন তারা হলেন- আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম, জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য গোলাম হায়দার, সাবেক এমপি অধ্যক্ষ শাহ আলম, পিরোজপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান এমপি আউয়ালের ভাই মজিবর রহমান খালেক, ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ইসাহাক আলী খান পান্না এবং সাবেক এমপি এনায়েত হোসেন খানের মেয়ে শেখ এনি রহমান।

মনোনয়ন প্রশ্নে অধ্যক্ষ শাহ আলম বলেন, ‘নেছারাবাদ যুক্ত হওয়ার পর আমি দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে অপেক্ষা করতে বলেন। তার নির্দেশ মেনে নিয়ে আমি নৌকার পক্ষে কাজ করছি। আমার উপজেলায় ভোটারের সংখ্যা ১ লাখ ৬০ হাজার। এখানে আওয়ামী লীগের একক মনোনয়ন প্রার্থীও আমি। সব মিলিয়ে আশা করি, দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।’

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘পিরোজপুর-১ আসনের বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে সেখানে ভোটযুদ্ধ প্রশ্নে একজন ক্লিন ইমেজের রাজনৈতিক নেতার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। সেই ক্লিন ইমেজ নিয়েই আমি দলের কাছে মনোনয়ন চাইব।’

এদিকে মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে বিএনপি নেতাদের মধ্যে নানা প্রশ্ন রয়েছে। এ আসনে জোট নেতাদেরই প্রাধান্য। এ আসনে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে জোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন সাঈদী। এখন আমৃত্যু কারাবাসে আছেন সাঈদী।

নিবন্ধন স্থগিত থাকায় নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণ নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও যে কোনো ফর্মে নির্বাচন করতে চাচ্ছেন নির্বাচনী মাঠে ফ্যাক্টর সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদী।

আলাপকালে শামীম সাঈদী বলেন, ‘জোটগতভাবে নির্বাচন প্রশ্নে পিরোজপুর-১ আসনটি জামায়াতের। আর এখানে দল আমাকে মনোনয়ন দিলে আমি অবশ্যই নির্বাচন করব।’

জোটের হয়ে আরও একজন মনোনয়ন চাওয়ার প্রতীক্ষায় জাতীয় পার্টির (জাফর) নেতা সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দার।

কথা হয় পিরোজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এবং আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রার্থী অধ্যাপক আলমগীর হোসেনের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা ১৩ বছর এমপি ছিল জামায়াতের লোক। ফলে সাংগঠনিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দল। নেতাকর্মীরাও হতাশ। এরপরও যদি আগামী নির্বাচনে এখানে অন্য দলের কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়, তাহলে তার চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কিছুই থাকবে না।’

বিএনপির আরেক মনোনয়ন প্রার্থী নেছারাবাদ উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও জেলার সহসভাপতি ফখরুল আলম বলেন, ‘আজন্ম বিএনপি করছি। আমার উপজেলায় আমি একা মনোনয়ন প্রার্থী এবং এখানে ভোটারের সংখ্যা ১ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি। যুগের পর যুগ দলের জন্য যা করেছি তার বিনিময়ে দল আমার কথা বিবেচনা করবে, এটাই আশা করি।’

জামায়াত থেকে সাঈদীর পরিবারের কাউকে প্রার্থী করা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সাঈদী সাহেবের বাড়ি তো এখন পিরোজপুর-২ আসনে। তারা কেন এখানে মনোনয়ন চাইবেন?’

এর বাইরে বিএনপির মনোনয়ন চাচ্ছেন জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি গাজী নুরুজ্জামান বাবুল এবং বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার সরোয়ার হোসেন।

মনোনয়ন প্রশ্নে গাজী নুরুজ্জামান বলেন, ‘পিরোজপুরে দল সংগঠিত করেছি আমি। আন্দোলন-সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছি। ওয়ান-ইলেভেনে দল যখন চরম সংকটে, তখন শক্ত হাতে দলের হাল ধরেছি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দল আমাকে মূল্যায়ন করবে, এটুকুই প্রত্যাশা।’

আওয়ামী লীগ-জামায়াত এবং বিএনপির পাশাপাশি এখানে আগামী নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে আরও যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন- চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট এমএ জব্বার এবং সিপিবির জেলা সভাপতি ডা. তপন বসু। নির্বাচন প্রশ্নে তারাও চালাচ্ছেন গণসংযোগ এবং নানা কৌশলী প্রচার।

তথ্যসূত্র : যুগান্তর

 


Comments