ছুটিতে থাকা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে সরকারি আদেশের চিঠিতে সই করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ।

রাত আটটায় তিনি ওই চিঠিতে সই করেন বলে মানবজমিনকে জানিয়েছেন আইনসচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক।

প্রেসিডেন্টের সইয়ের পর প্রধান বিচারপতির বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে আর কোন বাধা রইল না।

এর আগে ওই চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী সই করেন।

১৩ই অক্টোবর থেকে বিদেশে অবস্থান করতে চান উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি সরকারি আদেশের চিঠিটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলেন।

নানা প্রশ্ন

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ছুটিতে যাওয়া নিয়ে তোলপাড় চলছে সারা দেশে। গত দুই সপ্তাহ ধরে এ ইস্যুতেই দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে সবখানে নানা গুঞ্জন। প্রতিদিনই নতুন নতুন মোড় নিচ্ছে এ ঘটনা। কখনো প্রচার হচ্ছে, ‘ছুটি চেয়েছেন’ এস কে সিনহা। আবার কখনো শোনা যাচ্ছে, ‘ছুটিতে যাচ্ছেন’ তিনি। ছুটি পেয়ে অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমানোর খবরটি নিয়েই সবাই এখন মুখর।


একটু পেছনে ফেরা যাক। গত ২রা অক্টোবর খবর প্রকাশ হয়- প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা এক মাসের ছুটিতে যাচ্ছেন। এ জন্য তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে এক মাসের ছুটি চেয়ে আবেদনপত্রও লিখে পাঠিয়েছেন। তার অসুস্থতাজনিত ছুটির প্রথম ঘোষণাটি আসে সরকারের দুটি দপ্তর- অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। খবরটিতে অনেকেই বিস্মিত হন। আইনমন্ত্রী ঢাকঢোল পিটিয়ে সাংবাদিকদের সামনে প্রধান বিচারপতির লেখা সে চিঠি পড়ে শোনান। সে আবেদনের ছবি তুলে গণমাধ্যমে প্রকাশের অনুমতিও দেন। এক মাসের ছুটি চাওয়ার কারণ হিসেবে আবেদনে উল্লেখ করা হয়, তিনি (প্রধান বিচারপতি) শারীরিকভাবে অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য তিনি ছুটি চেয়েছেন। বলা চলে তখন থেকেই এস কে সিনহার এক মাসের ছুটি কার্যকর। তার অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্বভার তুলে দেয়া হয় আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়ার কাঁধে। সে অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি হিসেবে কাজও করছেন তিনি।


প্রধান বিচারপতির ছুটির আবেদনে বেশ কয়েকটি বানান ভুল এবং প্রধান বিচারপতির স্বাক্ষর নিয়ে প্রশ্ন উঠে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুলে ভরা এ আবেদনপত্রটি ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। প্রধান বিচারপতি গৃহবন্দি কি-না এ বিষয়টি নিয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। এস কে সিনহার ছুটির কথা যেদিন প্রচারিত হয়, সেদিন দুপুর পর্যন্ত তিনি অফিস করেছেন যথানিয়মে। তার অসুস্থতা এমন ছিল না যে, তাকে আদালত থেকে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে।

নিজের বাসায় যাওয়ার পরও গত এক সপ্তাহে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি। এর আগে কখনো স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আইসিডিডিআর,বি’তে যাননি তিনি। আবার দেখা যাচ্ছে, এস কে সিনহার বাসভবনে চিকিৎসকরা আসছেন। কখনও বা তিনি পূজা দিতে যাচ্ছেন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে। ভিসার জন্য অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনেও গেছেন তিনি। ইতিমধ্যে তিন বছরের ভিসাও পেয়েছেন।

সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য গভর্মেন্ট অর্ডার (জিও) লেটার প্রয়োজন। কিন্তু তার জিও লেটার নিয়েও তৈরি হয়েছে নানা প্রশ্ন। তাহলে কী ছুটির দরখাস্ত করার আগেই তিনি জিও লেটার সংগ্রহ করেছিলেন? নাকি অন্য কিছু? আসলেই কী হচ্ছে কেউ জানেন না।


মঙ্গলবার হঠাৎ করেই এস কে সিনহার ‘ছুটির গল্পে’ নিয়েছে নতুন মোড়। ‘১৩ই অক্টোবর থেকে ১০ই নভেম্বর পর্যন্ত’ বিদেশে থাকতে ইচ্ছুক জানিয়ে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের কাছে চিঠি দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই চিঠি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে প্রেসিডেন্টের হাতে যাবে। সর্বশেষ এই খবর জন্ম দিয়েছে নতুন জল্পনার। আগে ছিল ২রা অক্টোবর থেকে এক মাসের ছুটি।

এর মধ্যেই অস্ট্রেলিয়া সফর সেরে আসবেন এস কে সিনহা। আর এখন ১৩ই অক্টোবর থেকে ১০ই নভেম্বর। এই দুই রকম চিঠি নিয়েই যত ধূ¤্রজাল। আসলে কী হচ্ছে প্রধান বিচারপতির ছুটি নিয়ে? প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নিজেই ছুটিতে গিয়েছেন নাকি তাকে ছুটিতে যেতে সরকার বাধ্য করেছে- এ বিষয়টি নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে নানা অনুমান, সন্দেহ এবং বিতর্ক চলছে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতারা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেও পুলিশের বাধার কারণে পারেননি। এরপর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদিন অভিযোগ করে বলেছেন, ‘ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে চাপের মুখে ছিলেন প্রধান বিচারপতি। সে প্রেক্ষাপটে সরকারের চাপের মুখে প্রধান বিচারপতি ছুটিতে যেতে বাধ্য হয়েছেন।’

আবার আইনজীবী সমিতির সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ, মানববন্ধন আর অবস্থান কর্মসূচির মাঝে স্পষ্ট ফুটে উঠছে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে চাপের মুখে ছুটিতে পাঠানো হচ্ছে। আইনজীবী নেতারা তাকে দেশ ছেড়ে না যাওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন।

রাজনীতিক মহলে ছুটি নিয়ে বিতর্কের ঐতিহ্য থাকলেও সাংবিধানিক পদের অধিকারী কারও ছুটি নিয়ে এতটা রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক বা আলোচনা আগে কখনো শোনা যায়নি। তবে এই ছুটি যে ‘স্বাভাবিক’ বিষয়, তা বোঝানোর চেষ্টায় সরকারের পক্ষ থেকে দফায় দফায় সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে।

ছুটি নিয়ে সন্দেহ পোষণকারীদের উদ্দেশ্যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রশ্ন রেখেছেন, ‘তিনি কি অসুস্থ হতে পারেন না?’ সত্যিই তো, প্রধান বিচারপতির মতো সাংবিধানিক দায়িত্ব তো আর ব্যক্তি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার অসুস্থ হওয়া ঠেকিয়ে রাখতে পারে না! রাজনীতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ষোড়শ সংশোধনীর রায় এবং প্রধান বিচারপতির ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা বেশ কঠিন। কারণ প্রধান বিচারপতির ছুটির বিষয়টি আলোচনার তুঙ্গে ওঠার পেছনে রয়েছে একটি বিশেষ পটভূমি।

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ তথা নির্বাহী কর্তৃপক্ষের হাতে দেয়ার বিধানসংবলিত ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং দেশের রাজনীতির অতীত ও বর্তমান নিয়ে সরকার এবং ক্ষমতাসীন জোট ক্ষুব্ধ হয়েছিল এস কে সিনহার কিছু পর্যবেক্ষণে।

মন্ত্রী ও এমপিরা যে ভাষায় সংসদের বাইরে ও ভেতরে তার সমালোচনা করেছেন, তা মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে তার অবস্থান নিয়ে সরকারের অস্বস্তির বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছেন এমপিরা।

মন্ত্রীদের কেউ কেউ তাকে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হবে বলেও বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা তার নিন্দায় সরব হয়েছিলেন। সরকারসমর্থক আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির সব অনুষ্ঠানও বয়কটের কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন।

আওয়ামী লীগ সমর্থিত একটি সহযোগী সংগঠন প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে কর্মসূচিও দিয়েছিল। সবমিলিয়ে প্রধান বিচারপতির ওপর একধরনের রাজনৈতিক চাপ তৈরি হয়েছিল। প্রধান বিচারপতির ছুটি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে রাজনৈতিক মহলে। বিএনপি তথা ২০দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দের কাছে প্রধান বিচারপতির ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টি ¯্রফে ‘সাজানো নাটক’। প্

রধান বিচারপতিকে বিচারিক কার্যক্রম থেকে সরিয়ে রাখার জন্য এটা একটা ষড়যন্ত্র। ‘প্রধান বিচারপতিকে দেশ ত্যাগের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে’Ñ এমন অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ।

একই অভিযোগ করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও মওদুদ আহমদ। বিএনপির নীতিনির্ধারক ফোরামের সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতিকে অসুস্থ বলে যারা ছুটিতে পাঠাতে বাধ্য করেছেন, তারা একদিন আপনাকেও ছুটিতে পাঠাবে।’

অন্যদিকে প্রধান বিচারপতির ছুটি নিয়ে অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে দাবি করে এর একটি বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা চেয়েছে বামদলগুলো। সিপিবি, বাসদ ও গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা বলেছে, ছুটি ও বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে দেশবাসীর মনে যে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে অনতিবিলম্বে তার বিশ্বাসযোগ্য পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে।
তবে প্রধান বিচারপতির ছুটির বিষয়টিকে স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, মানুষ অসুস্থ হতে পারে, এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কারও অসুস্থতায় কী ব্যবস্থা নিতে হবে, সেটি সংবিধানের ৯৭ ধারায় বলা আছে।

এটি আন্দোলনের বিষয় নয়, আইনগত বিষয়। অবশ্যই আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে বলেছেন- ‘প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার অবসরে যাওয়ার কথা আগামী বছরের ১লা ফেব্রুয়ারি।

সুতরাং, এর আগ পর্যন্ত তিনি ছুটি থেকে ফিরে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। সরকার তার অবসরের আগে অন্য কাউকে প্রধান বিচারপতির পদে নিয়োগের কোনো উদ্যোগ নেবে না।’


অন্যদিকে সংবাদের পিছুচলা মানুষগুলো এস কে সিনহার বাড়ির আশেপাশে অবস্থান করছেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো। কখন দেশ ছাড়ছেন এস কে সিনহা! এই রহস্যের জট খুলতেই মূলত তাদের নির্ঘুম রাত কাটানো সেখানে। তবে এসবের বাইরেও মিলছে নিত্য নতুন সংবাদ।

 


Comments