প্রিয় সুচি,

যে বছর আপনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন, আমার জন্ম সে বছরেই। আপনার এই নোবেল প্রাপ্তি আমাদের মিয়ানমারের মানুষের জন্যে ছিল এক বিশাল গর্ব এবং আনন্দের ব্যাপার। রাখাইনের মংডু এলাকায় আমরা থাকি। সেই পুরো এলাকা আপনার নোবেল প্রাপ্তির উচ্ছ্বাসে আনন্দে ভেসে যায়। যেন এই বিজয়ের আনন্দ শুধু আপনার একার নয়, এ বিজয় সমগ্র মিয়ানমারের, যার শতবর্ষের ঐতিহ্যের অংশ আমরা রোহিঙ্গারাও ।

সুচি, সম্ভবত আপনার নোবেল শান্তি পুরষ্কার পাবার পরে আমরা রোহিঙ্গারা প্রথমবারের মতো অনুভব করতে পারি যে, আমরাও এ দেশের একটা অংশ। যে দেশের মাটিতে আপনার মতো শান্তিকামী বিশাল হৃদয়ের মানুষের জন্ম, সেই দেশের মাটিতে জন্ম নেয়ার পরম সৌভাগ্যে ক্ষণে ক্ষণে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠছিল আমাদের হৃদয়। কয়েক দশক ধরে সামরিক জান্তার হাতে অত্যাচারের শিকার হতে থাকা রোহিঙ্গাদের জন্যে আপনার নোবেল প্রাপ্তি বয়ে এনেছিল একটি আশার আলোকবর্তিকা।

আমরা, রোহিঙ্গারা আশায় বুক বাঁধলাম যে, এবার হয়তো আমাদের দুর্ভাগ্যের অবসান হবে। আমি ছোটবেলা থেকেই দাদার মুখে আপনার গুণগান শুনেছি। আপনার রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমক্রেসির প্রতি আমার দাদা এতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে, এ দলের নেতারা কখনো আমাদের এলাকায় কাজে এলে তাদের আপ্যায়নে নিজের গোয়ালের সবচেয়ে বড় ভেড়া এবং গরুটি পর্যন্ত জবাই করতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না।

আমার দাদা এবং বাবা আপনার প্রতি এতটাই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যে, তারা চাইতেন আমি যেন বড় হয়ে আপনার পদাঙ্ক অনুসরণ করি। আমার মা নিজেও আপনার বক্তব্য এবং জীবনবোধের একনিষ্ঠ অনুসারী। তিনি চাইতেন আমার ভেতরে আপনার লালিত আদর্শের বীজ বুনে দিতে।

২০১০ সালের এক আনন্দঘন দিনে আপনি যখন গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত হলেন, আমার পুরো পরিবার সহ সমস্ত রাখাইন রাজ্য উল্লাসে ফেটে পড়েছিল। অথচ, সাত বছর পর, আমরা- সেই রোহিঙ্গারা আজও নৃশংসতা এবং জাতিগত নিধনের বর্বরতার মুখে দাঁড়িয়ে আছি। এবং এবার স্বয়ং আপনার ইন্ধনে!

২০১৫ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ের পর আপনি আপনার দল থেকে মুসলিম প্রতনিধিদের সরিয়ে দিলেন। যেটি ছিল আপনার রাজনৈতিক ভীরুতা ও অনাচারের প্রথম পদক্ষেপ। তার কয়েকমাস পরেই উত্তর রাখাইনে আপনার প্রশাসন রাখাইন নিধন অভিযান শুরু করলো। এ সময়ে হত্যা করা হলো হাজারো রোহিঙ্গাকে। পুড়িয়ে দেয়া হলো পনের হাজার ঘরবাড়ি। হাজারো মহিলার উপর চালানো হলো গণধর্ষণ। এমনকি ৫ বছরের ছোট্ট শিশুটিও এই পাশবিকতা থেকে রেহাই পায় নি! শান্তিতে নোবেলজয়ী সুচি, আপনি কি করলেন তখন? তীব্র আন্তর্জাতিক নিন্দার মুখে দাঁড়িয়ে আপনি স্রেফ অস্বীকার করলেন এই সহিংসতা!

আপনি বললেন, আমাদের ওপর কোন অত্যাচার হচ্ছে না। উপরন্তু, আপনি আমাদের শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী রোহিঙ্গা পরিচয়কে অস্বীকৃতি দিলেন! শতবর্ষজুড়ে রাখাইনের মাটিতে ছড়িয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের আপনি বললেন বহিরাগত!

২৫শে আগস্ট থেকে শুরু এই সহিংসতার শিকার হয়ে কমপক্ষে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে চলে গেছে। যারা এখনো মিয়ানমারে আটকে আছে, তারা মৃত্যুভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

১লা সেপ্টেম্বর আমি ও আমার পরিবার দেশত্যাগে বাধ্য হই। তিন দিন- দুই রাতের এই সুদীর্ঘ যাত্রায় আমরা একটা ছোট্ট নৌকায় করে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করি। পরবর্তীতে আমাদের ঠাঁই মেলে কুতুপালং আশ্রয়শিবিরে। আমি মাত্রই জানলাম যে রাখাইনে আমাদের আবাসস্থল জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।

লোকে হয়তো বলবে যে, এই ধ্বংসযজ্ঞে দায়ী সামরিক জান্তা কিংবা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। আমি বলব, এই দায় কেবল আপনার! আপনি শুধু আমার ঘরই জ্বালিয়ে দেননি, জ্বালিয়ে দিয়েছেন আমার বই। জ্বালিয়ে দিয়েছেন আমার স্বপ্ন এবং ভবিষ্যৎ। আমার স্বপ্ন ছিল সিতওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে পড়ে একজন লেখক হবার ।

কিন্তু সু চি, আপনি নিশ্চয়ই অবগত যে সেখানে রোহিঙ্গাদের অধ্যয়ন নিষিদ্ধ! তাই আমি বাধ্য হয়ে বইপত্র এবং প্রবন্ধ পড়ে জ্ঞানার্জনের চেষ্টা করেছি। সুচি, আপনি শুধু রোহিঙ্গাদেরই হত্যা করেন নি, আপনি হত্যা করেছেন নেলসন ম্যান্ডেলার আদর্শকে। আপনি হত্যা করেছেন মহাত্মা গান্ধীর দীক্ষাকে। আপনি হত্যা করেছেন মানবজাতির মূল অহংকার- মানবতাকে।

এখন আমরা রোহিঙ্গারা আশ্রয়প্রার্থী হয়ে বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আছি। আপনার প্রতি আমার বাবার একটি প্রশ্ন আছে। তা হল- হে শান্তির নোবেল জয়ী, কেন এতকিছু হয়ে যাবার পরও একটিবার আপনি আমাদের নিপীড়িত রাখাইনদের দেখতে রাখাইন রাজ্যে অথবা বাংলাদেশে এলেন না?

আপনার কি এ ব্যাপারে আদৌ কোন মাথাব্যথা আছে? রোহিঙ্গারা বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে নিগৃহীত জাতি, এটা আমাকে যতটা না বিচলিত এবং ব্যথিত করে তুলছে, তার চেয়ে ঢের বেশি যন্ত্রণা আমায় দিচ্ছে এই ভাবনা যে, এই নিগ্রহ আমরা পাচ্ছি শান্তির নোবেল জয়ী অং সান সুচির মিয়ানমারে! এই কি তবে শান্তির অর্থ? সুচি, আপনি আপনার পথ বেছে নিয়েছেন, তা সবাই দেখতে পাচ্ছে।

ইতিহাসের পাতায় লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গার রক্ত আর বিলাপে লেখা আপনার নাম পৃথিবীতে অবশ্যই অমর হয়ে রইবে, তবে তা কি শান্তিতে নোবেলের জন্যে, নাকি আপনার নারকীয় নৃশংসতার জন্যে তার জবাব সুদূর ভবিষ্যতের কোন এক পাতায় আমরা রোহিঙ্গারা চোখের জলে লিখে রেখে গেলাম।


(অনলাইন আল জাজিরায় প্রকাশিত এক রোহিঙ্গার খোলাচিঠির অনুবাদ। এতে লেখকের নাম, ঠিকানা প্রকাশ করা হয় নি)

 


Comments