আপনি যদি হলিউড এর সিনেমা প্রযোজক হার্ভে ওয়েনস্টেইনের অসংখ্য হলিউড অভিনেত্রীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনা সম্প্রতি প্রকাশ হয়ে পড়ায় বিস্মিত হয়ে থাকেন তাহলে বলব বাস্তবতা সম্পর্কে আপনার কোনো ধরাণাই নেই।
মার্কিন সংস্থা RAINN (Rape, Abuse & Incest National Network) এর মতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ৯৮ সেকেন্ডে একজন ব্যক্তি যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।
আর প্রতি ছয়জন নারীর একজন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে ধর্ষণ বা ধর্ষণ চেষ্টার মুখোমুখি হন। আর ধর্ষণে শিকার হওয়া মার্কিন নাগরিকদের ৯০%ই নারী।
আমি একজন মুসলিম এবং একজন নাগরিক অধিকার বিষয়ক আইনজীবি। আর আমি বিশেষ করে নারীদের অধিকার নিয়ে ওকালতি করার বিষয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ আছে।
আমি শুধু আইনের জায়গা থেকেই নারী অধিকার নিয়ে ওকালতি করি না। বরং ইসলামি শিক্ষার মধ্যে যে বিস্তারিত কৌশল সমুহ আছে এবং নবী মোহাম্মদ (সা.) এর যৌন নিপীড়ন বিরোধী তৎপরতার নজিরও আমাকে উৎসাহ যোগায়।
আর হ্যাঁ, আমরা আজ খ্রিস্টান অধ্যুষিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে যৌন নিপীড়নের ক্যান্সার দেখতে পাচ্ছি তা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানেও আছে। আছে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে এবং রাষ্ট্রীয় নাস্তিক চীনেও। এ থেকে প্রমাণিত হয় আমরা পুরুষরা যৌন নিপীড়ন এবং লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে আমাদের যে দায়িত্ব আছে তা পালনে ব্যর্থ হচ্ছি।
প্রথমেই দুটি জিনিসের বুঝ দরকার। প্রথমত, একজন নারীর পোশাক, মদপান, বিয়ে এবং শিক্ষার মাত্রা পুরুষদের যৌন নিপীড়ক হয়ে ওঠার পেছনে কোনো অবদান রাখছে না। দ্বিতীয়ত, হাওয়ার মধ্যে যৌন নিপীড়ন ঘটছে না। বরং সমাজের প্রতিটি স্তর- সামজিক রীতি-নীতি, গণমাধ্যম এবং সরকারও ধর্ষণের সংস্কৃতির দোসর, যার ফলে যৌন নিপীড়ন টিকে আছে।
সামাজিক রীতি নারীদেরকে এই বিষয়ে উচ্চবাচ্য করতে ভয় দেখায়। যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করলে উল্টো তাকে সে কী ধরনের পোশাক পরেছে, সে নিজেই যৌন নিপীড়নের উস্কানি দিয়েছে কিনা এবং কেন সে আরো আগে অভিযোগ করেনি ইত্যাদি বলে অপমান করে।
গণমাধ্যমও নারীদেরকে অবহেলা করে এবং নারীদের কথা বলতে না দিয়ে ধর্ষণের সংস্কৃতির দোসর হচ্ছে। আরো কয়েক বছর আগেই যখন ওয়েনস্টেইনের বিরুদ্ধে হাকছেড়ে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেছিলেন অভিনেত্রী রোজ ম্যাকগোয়ান তখনই কেন গণমাধ্যম বিষয়টি মানুষের নজরে আনেনি?
কেন মার্কিন সমাজ হার্ভে ওয়েনস্টেইন, রজার আইলস, বিল কসবি, ও’রেইলি এবং এমনকি আমাদের কমান্ডরা ইন চিফ (ডোনাল্ড ট্রাম্প) এর মতো লোকদেরকে তাদের বিরুদ্ধে ডজন খানেক নারীর যৌন নিপীড়ন এবং ধর্ষণের অভিযোগ সত্ত্বেও সামনে এগিয়ে যেতে দিয়েছে?
কীভাবে আমরা সরকারের ওপর নির্ভর করতে পারি যখন ৯৭% ধর্ষকই কোনোদিন জেলে যায়নি, যখন বিচারকরা অজ্ঞান অবস্থায় এক কলেজ শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের দায়ে মাত্র তিন মাস কারাদণ্ড দিয়েছে, ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া শিশুর ওপর ধর্ষকদেরকেও সমান অভিভাবকত্বের অধিকার দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা অধিদপ্তর কলেজে নারীদেরকে যৌন নিপীড়ন থেকে রক্ষার আইন খর্ব করেছে?
আসল বিষয় হলো রাষ্ট্র নৈতিক কর্মের কর্তা নয়- বরং জনগন। কিন্তু লোকে যখন যৌন নিপীড়নকে বিনা বাধায় চলতে দেয় তখন আমরা সামাজিক নৈরাজ্যে নিপতিত হই। সত্য হলো, শুধু আইন করেই যৌন নিপীড়ন ঠেকানো সম্ভব এমনটা ভাবা বোকামি।
ফ্রান্সের আইনে যৌন নিপীড়নকে ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা সত্ত্বেও প্যারিসের গণ পরিবহনে যাতায়াতকারী নারীদের ১০০ শতাংশই যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছেন। ফ্রান্স সম্প্রতি নারীদের দেখে শিষ দেওয়াও বন্ধ করার জন্যও আইন করার প্রস্তাব করেছে। কিন্তু এই আইনও ব্যর্থ হবে। কারণ অপরাধ করার পরই শুধুই আইনে অপরাধের শাস্তি দেওয়া হয়।
কিন্তু আগেভাগেই অপরাধ প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা নেই আইনে। পুরো বিশ্বব্যাপীই এখন এই একই চিত্র বিরাজ করছে। প্রতিশোধমূলক পর্ন, লিঙ্গ ভিত্তিক সহিংসতা বা কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন যা কিছুর কথাই বলি না কেন বিশ্বব্যাপী এই সবগুলোরই চেহারা এক।
আর এখানেই ইসলামি শিক্ষা এবং নবী মোহাম্মদ (সা.) এর শিক্ষা সমাধান দিতে পারে, যা কোনো রাষ্ট্রই দিতে পারে না। এমন অনেক আছেন যারা যৌন নিপীড়নকে হয়তো কোনো সমস্যা বলেই গণ্য করবেন না। তেমনিই অনেকে আবার উচ্চ কর্তৃত্বের কাছে জবাবদিহিতার বোধকে এর সমাধান বলে মানতে নারাজ হবেন।
এটি একটি যুক্তিপূর্ণ বিতর্কও বটে। এর কারণ কংগ্রেস সদস্য টিম মারফির মতো ধার্মিক লোকদের ভণ্ডামির কারণেই এমনটা ভাবা হচ্ছে। যিনি গর্ভপাত এবং নাস্তিক্যের নিন্দা করেও নিজের স্ত্রীকে গর্ভপাতের অনুমতি দিয়েছেন।
অথবা ইন্ডিয়ানা প্রদেশের জিওপি চেয়ার রিক হ্যাভরসেন এর ভণ্ডামি যিনি নিজের মেয়েকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ অভিযুক্ত।
হ্যাঁ, এটা সত্যি যে ইসলাম সৃষ্টিকর্তার প্রতি জবাবদিহতার কথা বলে, কিন্তু ফাঁকা ধর্মতাত্বিক বুলির বাইরেও ইসলাম একটি প্রমাণিত সেক্যুলার মডেলের পরামর্শ দেয়।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্বের আহমদিয়া মুসলিমদের প্রধান আন্তর্জাতিকভাবে সম্প্রচারিত একটি ভাষণে বলেন, কোরআনের সুরা আল নিসার দ্বিতীয় আয়াতে পরিষ্কারভাবেই বলা হয়েছে নারীদেরকে কোনো পুরষের দেহ থেকে বা পুরুষের দেহের পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়নি।
বরং নারী ও পুরুষ উভয়কেই একটি একক আত্মা থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এবং তারা একই ধরনের এবং একই প্রজাতির মানুষ।
এভাবেই কোরআনের সুরা নিসার দ্বিতীয় আয়াতে নারী এবং পুরুষকে সমান সত্ত্বা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একই সুরার ২০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, সুতরাং একজন পুরষকে নিষেধ কর, যেন সে একজন নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করতে বাধ্য না করে। আর এভাবেই কোরআন একজন নারীর স্বায়ত্ব শাসন এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করেছে।
এই আয়াতে পুরষদেরকে নারীদের সঙ্গে দয়া দেখানো এবং নিজের স্ত্রীদের ব্যাপারে খারাপ কিছু না ভাবারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আসলে আবেগগত এবং মানসিক নিপীড়নের বিরুদ্ধেও রক্ষা কবজ তৈরি করা হয়েছে।
সুরা নিসারই ৩৫ নম্বর আয়াতের মাধ্যমে পুরষদেরকে নারীর প্রতি সহিংসতা করতেও নিষেধ করা হয়েছে। পুরুষদেরকে নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার আদেশ দিয়ে নারীদের ওপর কোনো ধরনের শারীরিক নিপীড়ন চালাতেও কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নারীর ওপর দৈহিক নিপীড়নও প্রতিরোধ করেছে ইসলাম।
এছাড়া কোরআনে পুরুষদেরকে নারীর সব ধরনের আর্থিক চাহিদা পূরণের আদেশও দেওয়া হয়েছে। এবং বলা হয়েছে নারী যা কিছু আয় করবে তা শুধু তার একারই। এর মধ্য দিয়ে নারীর ওপর আর্থিক নিপীড়নও প্রতিরোধ করা হয়েছে।
আর হিজাবের ব্যাপারে পুরষকেই আগে নিষেধ করা হয়েছে, বলা হয়েছে, নারীদের দিকে না তাকাতে। এবং বলা হয়েছে, নারীরা যেমন ধরনের পোশাকই পরুক না কেন পুরুষদেরকেই আগে তাদের গোপন অঙ্গ সমুহের হেফাজত এবং নিজের সতীত্ব রক্ষা করতে হবে। নারীর ওপর যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধেই এ আদেশ দেওয়া হয়েছে।
নবী মোহাম্মদ (সা.) এর একটি ঘটনায়ও বিষয়টি ফুটে উঠেছে। একবার এক অসম্ভব সুন্দরী নারী নবীর কাছে আসেন ধর্মীয় বিষয়ে দিক নির্দেশনা নিতে। সে সময় নবীর সঙ্গী আল ফজল ওই নারীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন তার চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য্য দেখে।
কিন্তু সেসময় নবীজি ওই নারীকে তার পোশাকের জন্য তিরস্কার না করে বরং আল ফজলের মুখটি ধরে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলেন যাতে তিনি আর ওই নারীর দিকে তাকাতে না পারেন।
এ থেকেই প্রমাণিত হয় নবী মোহাম্মদ (সা.) মূলত নারীদের সম্মান ও ইজ্জত রক্ষা এবং নারী নিপীড়ন প্রতিরোধের দায়িত্ব মূলত পুরুষদের ঘাড়েই চাপিয়ে দিয়েছেন।
নবীর মতে, পুরষদেরকেই নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন বন্ধে আগে পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া কোরআনে নারীদেরকে শালীনভাবে পোশাক পরার কথা বলা হলেও কেউ তা না করলে কোনো শস্তির কথাও বলা হয়নি।
অথচ একাধিক ক্ষেত্রে শুধু ধর্ষিতার অভিযোগের ভিত্তিতে নবী মোহাম্মদ অনেক ধর্ষককে শাস্তি দিয়েছেন। ইসলামের এই লিঙ্গ সমতামূলক পরিবেশে অনেক মুসলিম নারীই জ্ঞানী পণ্ডিত, যোদ্ধা, উদ্যোক্তা এবং দানবীর হিসেবে নিজের পরিচয় গড়েছেন তেমনি অনেকে আবার শুধু মা বা গৃহীনি হয়েও জীবন যাপন করেছেন।
হার্ভে ওয়েনস্টেইন হলো ঔদ্ধত্য, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, সামাজিক উদাসীনতার এক মহারোগের লক্ষণ মাত্র। কেননা তার সমাজের পুরুষরা তার যৌন নিপীড়নের কথা জানত কিন্তু এর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। ইসলাম এবং নবী মোহাম্মদ এর একটি বাস্তবভিত্তিক সমাধান সরবরাহ করেছেন।
নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন লক্ষণীয় হারে কমে যাবে যখন পুরুষরা নিজ দায়িত্বে তা করা বন্ধ করবে। এবং নিজে ব্যক্তিগতভাবে যৌন নিপীড়ন করেন না বলে তাদের আর কোনো দায়িত্ব নেই এমনটা ভাবাও বন্ধ করবে। ইসলামের মতে, প্রতিটি পুরুষই নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন বন্ধের জন্য দায়বদ্ধ- তাদের কথা দিয়ে বা কাজ দিয়ে।
ওয়েইনস্টেইনের মতো অনেক নিপীড়কই আমাদের রাস্তাগুলো দিয়ে হেঁটে যায়, যা আমদের প্রতিবোশিদেরকে আতঙ্কগ্রস্ত করে। আমরা পুরুষরা সকলে মিলে ইসলামের দিক নির্দেশনা ও প্রমাণিত পদ্ধতি এবং দৃষ্টান্তের অনুসরণে এই উম্মত্ততা বন্ধ করতে পারি, এবং পুনরায় যুক্তরাষ্ট্র ও পুরো বিশ্বে লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারি।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইনডিপিন্ডেন্ট এ প্রকাশিত কাসিম রাশিদ এর নিবন্ধ অবলম্বনে, কাসিম রাশিদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন অ্যাটর্নি, লেখক