পুরান ঢাকার চানখাঁরপুল এলাকায় একটি পুরনো দোতলা বাড়ি। বাইরে থেকে দেখে যে কেউ বুঝবে বাড়িটি পরিত্যক্ত।
এই বাড়ির দোতলায় একা থাকতেন আখলাক উদ্দিন নামের ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি। ছয় মাস ধরে তাঁর কোনো খোঁজ রাখেনি স্বজন-প্রতিবেশীরা।
এর মধ্যে সোমবার রাতে তাঁর একমাত্র বোন মুক্তা বেগম ওই বাড়িতে যান। দেখেন দরজা বন্ধ, ভেতরে সাড়া-শব্দ নেই। পরে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।
পুলিশ এসে দরজা ভেঙে দেখে, একজন মানুষ মরে পড়ে আছে। শরীরের মাংস পচে পোকামাকড় ধরেছে। লাশের শরীর থেকে মাংস আলাদা হয়ে কঙ্কাল হয়েছে। কঙ্কালটি আখলাক উদ্দিনের বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ।
পরে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কঙ্কালটি পাঠানো হয়। কঙ্কালটি আখলাকের কি না এ নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এত দিন মরে পড়ে থাকলেও প্রতিবেশীরা দুর্গন্ধ টের পেত। কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি। তাহলে এই কঙ্কাল কার?
আবার আখলাক ছয় মাস থেকে নিখোঁজ। এই কঙ্কাল যদি তাঁর হয়ে থাকে তাহলে এটা মৃত্যু নাকি হত্যা। এমন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে স্থানীয়দের মধ্যেও।
তবে পুলিশ জানিয়েছে, ছয় মাস ধরে আখলাক উদ্দিনের কোনো খোঁজ রাখেনি স্বজনরা। এরপর গত সোমবার রাতে তাঁর একমাত্র বোন মুক্তা বেগম ভাইয়ের খোঁজ নিতে ওই বাড়িতে যান। দরজা বন্ধ থাকায় ডাকাডাকি করেন। কোনো সাড়া না পেয়ে তাঁর সন্দেহ হয়।
একপর্যায়ে খবর পেয়ে পুলিশ এসে দরজা ভেঙে তাঁর লাশ উদ্ধার করে। ওই সময় বিছানায় শোয়ানো অবস্থায় তাঁর কঙ্কালটি পাওয়া যায়। আলামত মিলিয়ে ধারণা করা হচ্ছে, এটি আখলাকেরই কঙ্কাল। তবে সন্দেহ থাকায় ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ পরীক্ষার পর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।
বংশাল থানার ওসি শাহিদুর রহমান বলেন, চানখাঁরপুল এলাকার ৭৮/৩-ক নম্বর বাড়ির দোতলার একটি ঘরের দরজা ভেঙে কঙ্কালটি উদ্ধার করা হয়। প্রায় পরিত্যক্ত ওই বাড়িটির মালিক আখলাক নিজেই। তবে সেখানে অন্য কেউ থাকত না। তিনি অবিবাহিত ও মাদকাসক্ত ছিলেন। তবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে নাকি অন্য কোনো কারণে তার মৃত্যু হয়েছে তাঁর তদন্ত চলছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আখলাক উদ্দিন নিয়মিত মাদক সেবন করতেন। এলাকায় তাঁর পূর্ব পুরুষের অনেক সম্পত্তি ছিল। সেগুলো বিক্রি করে নেশার টাকা জোগাতেন তিনি। কোনো কাজ করতেন না। যে বাড়ি থেকে তার কঙ্কাল উদ্ধার হয়েছে, একমাত্র ওই বাড়িটি ছাড়া এখন আর তাঁর তেমন কোনো সহায় সম্পত্তি নেই।
এই বাড়িতে তিনি কাউকে ঢুকতে দিতেন না। মাঝে মধ্যে দরজা-জানালা বন্ধ করে মাদক সেবন করে হঠাৎ একদিন বের হতেন। এ কারণে তাঁর একমাত্র বোনের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো ছিল না।
দুই ভাই-বোনের মধ্যে আখলাক উদ্দিন ছিলেন বড়। তাঁর একমাত্র বোনের নাম মুক্তা বেগম। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আখলাক উদ্দিন তাঁর একমাত্র ভাই ছিল। কিন্তু মাদক সেবন করে নষ্ট হয়ে যান তিনি। এ কারনে ছয় মাস ধরে ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। খোঁজও রাখতেন না।
তাঁর ভাই অবিবাহিত ছিলেন। ওই বাড়িতে তাঁর ভাই একাই থাকতেন। বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ করে কাউকে বাসায় ঢুকতে দিতেন না। মাদক থেকে ফেরাতে অনেকবার চেষ্টা করেছেন তিনি। বিয়ের পর তিনি স্বামীর সংসারে চলে যান। এরপর ভাইয়ের সঙ্গে মাঝে মধ্যে দেখা করলেও তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন।
মুক্তা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, ‘মাদকই আমার শেষ করে দিয়েছে। অনেকবার তাকে এ পথ থেকে ফেরাতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তিনি আমার কোনো কথা শোনেননি। এ কারণে ছয় মাস ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল না। রাগ করে দেখাও করিনি। ’
তবে কিভাবে তার মৃত্যু হয় তা তার জানা নেই। পুলিশকে বলেছি তদন্ত করে বের করতে। আখলাক উদ্দিনকে হত্যা করা হয়েছি নাকি মাদক সেবনের কারণে তার মৃত্যু হয় তার তদন্ত চলছে। যদিও পুলিশ এখনো পর্যন্ত জানতে পারেনি তাঁর মৃত্যু রহস্য। ময়না তদন্তের জন্য গত সোমবার রাতে তার কঙ্কালটি ঢাকা মেডিক্যাল (ঢামেক) মর্গে পাঠানো হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আখলাক উদ্দিন খাঁজা, মদ এমনকি ইয়াবাও সেবন করতেন। এলাকার অনেকেই তাঁর সম্পর্কে এটাই জানেন। এ কারণে তাঁর সঙ্গে আত্মীয়স্বজনের কোনো যোগাযোগ ছিল না। একমাত্র বোনও তাঁর কোনো খোঁজ রাখতেন না এ কারণে।
মাঝে মধ্যেই বাড়িতে তালা মেরে নিজে নিজেই হারিয়ে যেতেন। দীর্ঘদিন পর বাসায় ফিরলে এলাকার লোকজনের সঙ্গে তার কখনো কখনো দেখা হতো। একাই থাকতেন বাড়িতে। একমাত্র বোন ও স্বজনদের সঙ্গে ছয় মাস তাঁর কোনো যোগাযোগ ছিল না। এত দিন কেউ তার খোঁজও নেননি। তাঁর বাড়িতেও কেউ ঢোকেনি।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী বংশাল থানার এসআই তৌহিদুল ইসলাম বলেন, বাড়িটি দীর্ঘদিনের পুরনো। দোতলা বাড়িতে আখলাক উদ্দিন একাই থাকতেন। বাড়িতে ঢোকার পথসহ পুরো বাড়িটিই ময়লা-আবর্জনায় ভরা। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় পরিত্যক্ত বাড়ি।
দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকেই প্রকট গন্ধ লাগে। চারপাশে শ্যাওলা জমে তাঁর ওপর ঘাস জন্মেছে। শরীরের মাংস পচে পোকামাকড়ে খেয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেই তাঁর কঙ্কালটি উদ্ধার করা হয়। মৃত্যুর পর লাশে পচন ধরে। এরপর মাংস আলাদা হয়ে কঙ্কাল হয়ে পড়ে ছিল। লাশের চারপাশে শ্যাওলা জমে ছিল। নানা কীটপতঙ্গের বাসার মধ্যেই পড়ে ছিল লাশটি।