পুলিশে বাড়ছে ড্রপআউট। পুলিশ বিভাগের লোভনীয় ইউনিটে নিয়োগ পেয়েও অনেকে চাকরি করতে চাচ্ছেন না। যোগ দিয়েও অনেকে প্রশিক্ষণের পর কাজে যোগ দিচ্ছেন না।

গত তিন বছরে বিসিএসে (পুলিশ) নিয়োগের জন্য গেজেট প্রকাশের পরও ১৬ চাকরি প্রত্যাশী এএসপি পদে যোগ দেননি।

সার্জেন্ট, এসআই বা কনস্টেবল পদে ড্রপআউটের সংখ্যা অনেক বেশি। তাই নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পূরণ করতে পারছে না পুলিশ সদর দফতর।

পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছে।

এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য হল- দেশে মেধাবীদের সংখ্যা বাড়ছে। তারা পুলিশের বিভিন্ন পদসহ অন্যন্য সরকারি দফতরের নানা পদে আবেদন করেন। কাছাকাছি সময়ে যাদের একাধিক চাকরি হয়ে যাচ্ছে, তারা পছন্দসই চাকরিকেই বেছে নিচ্ছেন। এ কারণেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।

জানা যায়, চলমান ৭৩১ জন সার্জেন্ট নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ১১ জন মেডিকেল টেস্টেই অংশ নেননি। মেডিকেল টেস্টের পর একজন চাকরিপ্রার্থী সার্জেন্ট পদে চাকরি করতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। তাকে যেন ট্রেনিংয়ে না পাঠানো না হয়, সেজন্য এরই মধ্যে তিনি পুলিশ সদর দফতরে আবেদন করেছেন। এখনও ট্রেনিং শুরু হয়নি। ট্রেনিং শুরু হলে অনেকেই অনুপস্থিত থাকবেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। এর আগের ব্যাচে ৬৫০ জনকে সার্জেন্ট পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হলেও ট্রেনিংয়ে (প্রশিক্ষণ) অংশ নেন ৬২৮ জন।

সূত্র জানায়, ৩৫তম বিসিএসে ১২০ জনকে নিয়োগ দেয়ার জন্য গেজেট প্রকাশ করা হয়। তাদের মধ্যে ১১৩ জন পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে যোগ দেন। পুলিশ সদর দফতরে যোগদানের পরও ইউনিটে যোগদানে বিরত থাকেন সাতজন।

৩৪তম বিসিএসে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা ১৪৯ জনের মধ্যে ১৪৮ জন যোগদান করেছেন।

৩৩তম বিসিএসে ১৫৬ জনকে এএসপি পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। তাদের মধ্য থেকে ১৪৮ জন বিভিন্ন ইউনিটে যোগদান করেন। আটজন ড্রপআউট হয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১২ সালে এসআই পদে ১ হাজার ৬২১ জনকে ট্রেনিংয়ে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়। তাদের মধ্যে ১৯২ জন ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করেননি।

যারা ট্রেনিং করেছেন, তাদের মধ্য থেকে ৭৬ জন পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে যোগদান করা থেকে বিরত থাকেন।

২০১৩ সালে ১ হাজার ৫২০ জনকে ট্রেনিংয়ের জন্য সুপারিশ করা হয়। কিন্তু ট্রেনিংয়ে অংশ নেন ১ হাজার ৩৩০ জন। ট্রেনিং শেষে কাজে যোগ দেন ১ হাজার ৩২১ জন।

২০১৪ সালে ১ হাজার ৫২০ জনকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৩২৯ জনকে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে কাজে যোগ দেন ১ হাজার ৩২১ জন।

২০১৫ সালে ১ হাজার ৫১৭ জনকে এসআই পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়। এদের মধ্য থেকে গত বছরের ২৭ আগস্ট ট্রেনিংয়ে যোগ দেন ১ হাজার ৪৩২ জন।

প্রশিক্ষণের পর কাজে যোগ দেন ১ হাজার ৩২১ জন। ট্রেনিং শেষ করার পরও গত চার বছরে প্রায় ২০০ জন এসআই কাজে যোগদান করেননি।

তাছাড়া নিয়োগের জন্য সুপারিশকৃত বড় একটি অংশ প্রশিক্ষণেই যোগ দেয়নি।

পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা যায়, গত চার বছরে ৪৬ হাজার কনস্টেবল নিয়োগের জন্য পাঁচটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে প্রশিক্ষণে পাঠানোর জন্য ৪১ হাজার ৭৭৬ জনকে সুপারিশ করা হয়। প্রশিক্ষণে যোগদান করেন ৪১ হাজার ৪৯৭ জন।

গত তিন বছরে ১০ হাজার করে কনস্টেবল নিয়োগের জন্য চারটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।

এর আগে ২০১৪ সালে ছয় হাজার কনস্টেবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। কিন্তু নিয়োগদানের ক্ষেত্রে কখনও কোটা পূরণই করতে পারেনি সদর দফতর।

চলতি বছর ১০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত থাকলেও প্রশিক্ষণে গিয়েছেন ৮ হাজার ৭৩৪ জন।

২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগের জন্য পৃথক দুইটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে প্রশিক্ষণে যোগ দিয়েছেন ১৭ হাজার ৮৩১ জন।

২০১৫ সালে ১০ হাজার পদের বিপরীতে প্রশিক্ষণে যোগ দেন ৯ হাজার ৩৫২ জন কনস্টেবল।

২০১৪ সালে ৬ হাজার কনস্টেবল নিয়োগের কথা থাকলেও প্রশিক্ষণে যোগ দেন ৫ হাজার ৮৮০ জন। প্রশিক্ষণ শেষে কর্মস্থলে যোগ দেননি অনেকে।

এভাবে ঝরেপড়া সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান আল-মামুন বলেন, ‘দেশে মেধাবীদের সংখ্যা বাড়ছে। তারা পুলিশের বিভিন্ন পদসহ অন্যান্য সরকারি দফতরের নানা পদে আবেদন করেন।

কাছাকাছি সময়ে কারও একাধিক চাকরি হলে তিনি তার পছন্দসই চাকরিকেই বেছে নেন।

কেউ যদি একই সময়ে এসআই/সার্জেন্ট ও এএসপি পদে চাকরি পান, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই এএসপির চাকরিকেই বেছে নেবেন। এ কারণে পুলিশের নিচের পদগুলোয় ড্রপআউট বাড়ছে।’

তাছাড়া পুলিশে চাকরির ক্ষেত্রে ভেরিফিকেশন বা মেডিকেল টেস্টেও অনেকে বাদ পড়েন বলে তিনি জানান।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি মনিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অনেকই মনে করেন, টাকা ছাড়া পুলিশে চাকরি হয় না। কথাটা সত্য নয়। যদি টাকা দিয়ে কেউ চাকরি নিতেন, তাহলে চাকরি হওয়ার পর নিশ্চয়ই ড্রপআটউ হতেন না।

তিনি শতভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে জানান, নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশের কোনো কর্মককর্তা অর্থিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত নন। যারা মেধাবী, তাদেরই চাকরি হয়। এক্ষেত্রে টাকা-পয়সার কোনো বিষয় জড়িত নয়। যারা লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন, তারা সবাই মেধাবী।

উদাহরণ দিয়ে এআইজি মনিরুল বলেন, অসাধু চক্রের কোনো সদস্য যদি লিখিত পরীক্ষায় পাস করা ২০ জনের কাছ থেকে টাকা নেয়, তাহলে তাদের মধ্যে ৮-১০ জনের চাকরি হয় (মেধার ভিত্তিতেই)।

কিন্তু যাদের চাকরি হয়, তারা মনে করে টাকার বিনিময়েই চাকরি হয়েছে।

 


Comments