শরীয়তপুরের নড়িয়ায় আদম পাচারকারী চক্রের সদস্য উজ্জল ফকিরের খপ্পরে পরে পথে বসেছে শতাধিক পরিবার। এলাকার অসহায় দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের কম খরচে ইতালি পাঠিয়ে বিলাসী জীবন যাপনের স্বপ্নের ফাঁদে ফেলে লিবিয়ায় নিয়ে অপহরণ চক্রের কাছে বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি লিবিয়া পুলিশ অপহরণ চক্রের জিম্মি দশা থেকে উদ্ধার করে দেশে পাঠিয়েছেন বেশ কয়েকজন যুবককে। এদিকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ভয়ে আইনের আশ্রয়ও নিতে পারছে না ভুক্তভোগীরা।
ভুক্তভোগী পরিবার ও স্থানীয়রা জানায়, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার পূর্ব কেদারপুর গ্রামের হাফেজ নুরুল ইসলাম ফকিরের ছেলে উজ্জল ফকির দীর্ঘদিন লিবিয়া প্রবাসী ছিলেন।
বছর খানেক আগে দেশে ফিরে লিবিয়া দিয়ে সমুদ্র পথে ইতালিতে লোক পাঠানো শুরু করেন।
এলাকার অসহায় দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের কম খরচে ইতালি পাঠিয়ে বিলাসী জীবন যাপনের স্বপ্নের ফাঁদে ফেলে গত এক বছরে শতাধিক উঠতি বয়সের যুবককে লিবিয়া পাঠান।
এদের অধিকাংশরাই লিবিয়াতে আন্তর্জাতিক অপহরণ চক্রের হাতে জিম্মি হন। তাদের স্বজনদের কাছে জিম্মির খবর দিয়ে অপহৃতদের মুক্ত করতে পুণরায় আড়াই লক্ষ টাকা দাবি করেন দালাল উজ্জল। বেশ কয়েকজন যুবকের স্বজন টাকা দিয়ে তাদেরকে উদ্ধার করে পুনরায় টাকা দিয়ে ইতালী পাঠিয়েছে।
কিন্তু পূর্ব কেদারপুর গ্রামের আব্দুল কাদের খানের ছেলে শাহিন খান, গোড়া গাঁও গ্রামের মিয়াচান শেখের ছেলে সাইফুল, পূর্ব কেদারপুর গ্রামে কামাল উদ্দিন শেখের ছেলে জাকির হোসেন, পূর্ব কেদারপুর মসজিদের ইমাম পটুয়াখালী জেলার নুর মোহাম্মদ শিকদারের ছেলে মাছুম শিকদার, গোড়া গাও গ্রামের নুরু খন্দকারের ছেলে লালন খন্দকার, ঘড়িসার গ্রামের আবু কালাম, চাকধ গ্রামের মনির, ভোজেস্বর গ্রামের আবু হানিফ ও সিয়াম এর স্বজনরা টাকা দিতে না পারায় তাদেরকে সমুদ্র পাড়ে আটকে রেখে নির্যতন করতে থাকে।
গোপন সংবাদ পেয়ে লিবিয়ার পুলিশ তাদের উদ্ধার করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ছয়মাস লিবিয়ার কারাগারে জেল খেটে সম্প্রতি বেশ কয়েজন যুবক দেশে ফেরার পর ঘটনা জানাজানি হয়।
আদম পাচার চক্রের সদস্য উজ্জলের ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে পরিবারগুলো।
পূর্ব কেদারপুর গ্রামের আব্দুল কাদের খান বলেন, উজ্জল ফকিরের বাবা হাফেজ নূরুল ইসলাম আমাকে বলে তোমার ছেলেকে ইতালি পাঠাতে পারি ৬ লক্ষ টাকা দিতে হবে।
৬ লক্ষ টাকা যোগার করতে আমি আমার পালের ৬টি গরু বিক্রি করে। এরপর এনজিও থেকে কিস্তি এনে উজ্জল ফকিরে বাবার কাছে ৬ লক্ষ টাকা বুঝিয়ে দেই। উজ্জল ফকির আমার ছেলেকে লিবিয়া নিয়ে বিক্রি করে দেয়। তারা একটি জঙ্গলে আমার ছেলেকে এক মাস আটকে রেখে নির্যাতন চালায়।
পরে লিবিয়ার পুলিশ তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়। ছয়মাস জেল খাটার পর সরকার তাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসে বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন কাদের খান।
তিনি বলেন, আমার মাথায় ঋনের পাহাড় আমি কিভাবে বাচবো জানিনা। এক পোয়া ডাল কিনে বালবাচ্চা নিয়ে খাবো সে অবস্থা আমার নাই। আমি ডিবি অফিসে অভিযোগ করেছি। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।
লিবিয়া ফেরত মাছুমের বাবা হাফেজ নূর মোহাম্মদ শিকদার বলেন, পহেলা বৈশাখের একদিন পর আমার ছেলের ফ্লাইট হয়েছে। তার তিনদিন পর সে লিবিয়া পৌঁছার পর উজ্জল ফকির ও তার বাবা নুরু ফকিরের কাছে প্রথমে দিয়েছি ৪ লক্ষ ১০ হাজার টাকা ও পরে দিয়েছি আরো ৯০ হাজার টাকা।
আর খরচ বাবদ আরো ৫০ হাজার টাকা তারাই নিয়ে পার্সপোর্ট মেডিকেলসহ নানাভাবে খরচ করছে। এখন আমার ছেলেকে যে ভাবে নির্যাতন করছে আমি এর বিচার চাই এবং ক্ষতি পূরণ চাই। কিন্তু স্থানীয় একটি চক্র এ ঘটনায় বিচার ও ক্ষতিপূরণ চাওয়ায় আমাদের হুমকি দিচ্ছে। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি।
লিবিয়া ফেরত সাইফুলের মা সাহিদা বেগম বলেন, আমরা গরিব মানুষ। একটু সম্পদ ছিল বিক্রি করে উজ্জল ফকিরকে দিয়ে ছেলেকে ইতালি পাঠিয়েছি। সে লিবিয়া নিয়ে আমার ছেলেকে বিক্রি করে দিয়েছে। কোন দিন ছেলেকে একটা থাপ্পরও দেই নাই। সেই ছেলেছে মারতে মারতে শেষে করে দিয়েছে।
এখন ছেলেকে ডাক্তার দেখাবো সে টাকাও আমার নাই। ছেলে চলতে পারে না। খাইতে পারে না। দুটো ভাত মেখে খাইয়ে দিলেও বমি করে ফেলে দেয়। আমার ছেলেকে জীবনের জন্য পঙ্গু করে দিয়েছে। কে এর বিচার করবে?
লিবিয়া ফেরত সাইফুল ঘটনার বর্ননা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। শুধু বলেন, যে নির্যাতন করেছে তা বলে বুঝানো যাবে না। সকালে একটা রুটি আর রুল দিয়ে একটা পিটান দিত। আবার গভীর রাতে একটা রুটি দিত আবার বেতের রোল দিয়ে একটা পিটান দিত।
প্রথমে একটানা ১৫দিন কোন খাবার দেয়নি। শুধু পানি খেয়ে ছিলাম। আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়ে আনবে তা ভাবিনি। ভেবেছি ওখানেই একসময় মরে যাব ওরা সমুদ্রে ফেলে দিবে। আল্লাহ ছাড়া কে এর বিচার করবো।
লিবিয়া ফেরত শাহীন খান বলেন, প্রতিদিন ওরা অস্ত্র নিয়ে আসতো। এসেই মারপিট শুরু করতো। কারো সাথে কথা বলতে দিত না। সারা দিন বালুর মধ্যে শুইয়ে রাখতো।
আমাদের জীবনে আর কোন কাজ করা সম্ভব না। পায়ে পিঠে অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন দেখান তিনি। তিনি জানান, এক ফ্লাইটে উজ্জল ফকিরের আমরা ১৯জন লোক গিয়েছিলাম। এর দু'একজন পরে আড়াই লক্ষ টাকা করে দিয়ে উদ্ধার হয়েছে। আর আমরা বাকিরা জেল খেটে দেশে ফিরেছি। আমরা সরকারের কাছে বিচার চাই।
কেদারপুর গ্রামের মান্নান গোরাপির মেয়ে মনি বলেন, আমার ভাই খোকন গোরাপিকে উজ্জল দালালের মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে ইতালী পাঠিয়েছিলাম। উজ্জল দালাল লিবিয়া নেয়ার পর খোকন ভাইকে দুইবার অপহরণ চক্রের সদস্যদরা অপহরণ করে।
একবার উজ্জলের পার্টনার লোনশিং গ্রামের লিবিয়া প্রবাসী সোহেলের মাধ্যমে আড়াই লক্ষ টাকা দিয়ে উদ্ধার করি। পরে আবারো তাকে অপহরণ করা হলে গৌরঙ্গ বাজারের লিবিয়া প্রবাসী আব্বাসের মাধ্যমে তাকে উদ্ধার করা হয়। পরে সে ইতালিতে পৌঁছেছে। আমার অনুরোধ এভাবে যেন কেউ তাদের স্বজনকে ইতালি না পাঠায়।
এদিকে অভিযুক্ত উজ্জল ফকিরের বাড়ি গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তার পরিবারের কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি।
জেলা গোয়েন্দা শাখা ডিবি র ওসি সুব্রত কুমার সাহা বলেন, পুলিশ সুপার মহোদয়ের মাধ্যমে একটি অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে।
শরীয়তপুর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নড়িয়া সার্কেলের আব্দুল হান্নান বলেন, সুনিদিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।