সংসারের বোঝার চেয়েও আমার কাছে পাথর চাপা মনে হয় অনেক সহজ। ছোটখাটো একটি চাকরি করি। বেতন পাই মাঝারি মানের। সেই বেতন দিয়ে সংসারের যাবতীয় খরচ বহন করতে হয়।
সব দিক সামলাতে গিয়ে অনেক সময় হাঁফিয়ে উঠি। অবশ হয়ে যায় শরীর।
পা যেন আর চলে না। সবই মেনে নিয়েছি। মেনে নিতে হয়। আশেপাশের মানুষের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে নিজের শরীরের ওপর বোঝা বাড়াচ্ছি। স্ত্রীর আবদার, পুত্র ও কন্যাদের আবদার তো আছেই। মাঝে মাঝে ভাইবোনের আবদারও মেনে নিতে হয়।
এতে করে দেনার উপর ভর করতে হয়। ক’দিন ধরে ঘরে অশান্তি। শীত আসছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শীতের প্রসাধনী কেনার তাগিদ। ভালো হোক মন্দ হোক একটা কিনে এনে দিতে হয়। এগুলো বাড়তি খরচ। আর সারা বছর তো ম্যাচিং-এর একটা ব্যাপার রয়েই গেছে।
সংসার কিভাবে চলছে? এমন প্রশ্ন করতেই গড়গড় করে বলতে থাকেন একটি বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত হিসাবরক্ষক আবদুল মোমেন। বলেন, শাড়ি কিনলেই হয় না। এর সঙ্গে ম্যাচ করে কিনতে হয় ব্লাউজ, পেটিকোট, মাথার ওড়না। এখন সমাজে ম্যাচ করে না গেলে নাকি হয় না।
সমাজ তাদের নাকি ক্ষ্যাত বলে। শুধু তাই নয়? এর সঙ্গে মেলাতে হয় ঠোঁটের লিপিস্টিক, হাতের নেইলপলিশ, পায়ের জুতা। ছেলে হলে তার লাগে বেল্ট, মোজা আরো কত কি?
এতকিছু সামাল দিতে গিয়ে শূন্য হয়ে পড়ি আমি। ভাবি কেন আমার বড় লোকের ঘরে জন্ম হলো না। কেন অভাব আমার নিত্যসঙ্গী হলো। সন্তানদের লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করবো আর সেই সন্তান আমাকে দেখবে সেটাও তো এখন অনেক দেরি। তাছাড়া, সন্তান দেখবে কিনা এরইবা কি গ্যারান্টি আছে।
আজকাল চারদিকে তাকালে দেখা যায়, বিয়ের পরই সন্তানরা তাদের স্ত্রী নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। কেউ কেউ মা-বাবাকে দেখে। কেউ একেবারেও ফিরে তাকায় না।
মোমেন বলেন, শীত আসছে তাই গত পনের দিন ধরে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। শীতের প্রসাধনী কেন কিনে এনে দিচ্ছি না।
স্ত্রী বলে, এগুলো তো প্রয়োজনীয়ই। মেয়ে কান্না করছে। কি লাগবে? লম্বা লিস্ট আমার হাতে তুলে দিলেন স্ত্রী। মুখের মেকআপ, ফেস পাউডার, চোখের সাজ, ঠোঁটের সাজ, ভ্রু এবং ঠোঁটের আউটলাইন সাজ।
মাথার চুলের জন্য ভালো মানের নারিকেল তেল তো লাগে গোটা বছরই। এক বছর আগেও যেখানে হাজার, দেড় হাজার টাকা দিলে সব হয়ে যেতো, এখন সেখানে লাগে কমপক্ষে চার হাজার টাকা। বেতন তো বাড়ে না। এগুলো মেটাবো কি করে? বাধ্য হয়ে দেনা করতে হয়।
সংসারের খরচে টান দিতে হয়। কথা হয়, কসমেটিকস ব্যবসায়ী আলম হোসেনের সঙ্গে। তার দোকান যাত্রাবাড়ী সামাদ সুপার মার্কেটে। তিনি বলেন, সারা বছর টুকটাক বিক্রি হলেও দুই ঈদে আমাদের বিক্রি হয় বেশি। আর শীতের শুরুতে ক্রেতার চাপ পড়ে। তিনি বলেন, শীত, গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই নারীরা মেকআপ নেন। অফিসে যাওয়ার সময় কিংবা কোনো পার্টিতে সাজার জন্য বা কোনো উৎসবে হালকা কিংবা ভারি সাজের দরকার হয় মেকআপের।
আর এই মেকআপের জন্য কসমেটিকস বা মেকআপ কিটস কিনতেই নারীদের ভিড় বেশি। তারাই পুরুষদের প্রয়োজনীয় মেকআপ কিনে নিয়ে যান।
আলম হোসেন বলেন, ভালো ব্রান্ডের মধ্যে লরিয়েল খুবই জনপ্রিয়। গুণগত দিক দিয়েও এটি বেশ ভালো। তার কাছে দামের কথা জানতে চাইলে বলেন, সাধারণত মুখের মেকআপ ৪৫০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত রয়েছে।
ফেস পাউডার সিঙ্গেল ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা। ডাবল ৮০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা। পেনকেক ৫৫০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা। আবার রেভলন ব্রান্ডেরগুলোর দাম কিছুটা কম রয়েছে। ল্যানবাম ব্রান্ডের দামও কিছুটা কম। এছাড়া ল্যাকমি ব্রান্ডের দামও অনেকটা কম।
তিনি বলেন, আরো অনেক ব্রান্ড রয়েছে বাজারে। তবে নিম্ন ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষগুলো দেশি মেকআপই কিনে নেন। আসলে টাকার উপরই সব। আর যাত্রাবাড়ী এলাকায় সাধারণত বসবাস করেন নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। শ্রমজীবী, চাকরিজীবী ও ছোট ব্যবসায়ীদের বসবাস এখানে।
তাই আমাদের ক্রেতার দিকে বিবেচনা করে সে ধরনের মেকআপ রাখতে হয়।
তিনি বলেন, নারীদের পছন্দের তালিকায় থাকা খুব পরিচিত কিছু ব্রান্ডের লিপস্টিক, আইলাইনার ও কাজল রয়েছে। খুব সহজেই যেকোনো মার্কেট থেকে এসব কসমেটিকস সামগ্রী সংগ্রহ করা যায়। বর্তমানে চাহিদার কথা মাথায় রেখে কসমেটিকস কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন রংয়ের লিপস্টিক বাজারে ছেড়েছে।
এরমধ্যে জর্ডানা নরমাল ১১০ টাকা, পেন্সিল ২২০ টাকা, পারসোনি নরমাল ১০০ টাকা এবং পেন্সিল ২২০ টাকা। মিওর নরমাল ১১০ টাকা এবং পেন্সিল ২১০ টাকা। ভারতের ল্যাকমে ১৮০ টাকা থেকে ২২০ টাকা। বিদেশি ব্রান্ডের ছাড়াও সাধারণ কিছু লিপস্টিকও বাজারে পাওয়া যায়।
যেগুলোর দাম ৬০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে। চোখের মেকআপ কাজল, আইলাইনার আইশ্যাডো। এসব ব্র্রান্ড ভেদে ৬০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকা পর্যন্ত রয়েছে। আর নেইলপলিশ ৪০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, ইদানীং বাজারে নকল মেকআপ সামগ্রীতে ছেয়ে গেছে। তাই সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। এসব সামগ্রী সস্তা ও আকর্ষণীয় হলেও ত্বকের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে বেশি। তবে রূপ সচেতনরা বসুন্ধরা শপিং মল, নিউমার্কেট, গাউসিয়া, চাঁদনী চক, ধানমন্ডির বিভিন্ন বিপনি বিতান, মিরপুর, মৌচাক, মালিবাগ, এলিফ্যান্ট রোডের বিপণি বিতানগুলো থেকে মেকআপ কিটস কেনেন।
নিম্নবিত্ত মানুষ শীতে সাধারণত স্নো ব্যবহার করেন। বেশ ক’বছর ধরে মুখে প্রতিদিন ব্যবহার করার জন্য লিভার ব্রাদার্সের ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ব্যবহার করেন। এ কোম্পানি শীত ও গ্রীষ্ম দুই ঋতুর জন্যই আলাদা ভাবে মেকআপ তৈরি করছে। পাট গবেষণাগারে চাকরি করেন মোফাজ্জল।
তিনি ফার্মভিউ সুপার মার্কেটে এসেছেন। বলেন, আমার দুই মেয়ে। তারা কলেজে পড়ে। ক’দিন ধরে শীতের মেকআপ সামগ্রী চাইছে। তাই এসেছি এখানে। বাড়তি চাপ হলেও প্রয়োজনীয় মনে করে কিনছি। এতে সংসারের বাজেটে টান পড়ছে। আমাদের মতো লোকজনের কষ্ট করেই শখ পূরণ করতে হয়। সন্তানের শখ, স্ত্রীর শখ পূরণ করতে গিয়ে নিজের শখ কখনো পূরণ করতে পারি না। এভাবেই চলছে সব সময়।
তারপরও শত কষ্টের মাঝে একটু সুখ পাই যখন দেখি এসব নিয়ে গেলে সন্তান খুশি হয়। হাসিমুখে জড়িয়ে ধরে। আমাদের আনন্দ এখানেই। ভেতরের সব কষ্ট সেই এক মুহূর্তের জন্য হলেও যেন ছিটকে পড়ে।
সরকারি বদরুন্নেসা কলেজে অনার্সে পড়েন মেহরিন। তিনি বলেন, সবকিছুতে ম্যাচ করে না পড়লে বান্ধবীরা আঁড় চোখে তাকায়। হাসি-তামাশা করে। ফলে বাবাকে চাপ দেই। কোথাও বেড়াতে গেলে কাপড়ের সঙ্গে ম্যাচ করে জুতা, লিপিস্টিক সব পরতে হয়। জানি বাবার কষ্ট হবে। তারপরও নিরুপায় হয়ে বলি। আসলে সমাজে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমাদের মতো সংসারগুলো জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে।
কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। চন্দন দেবনাথ নিজস্ব টেইলার্স চালান। বলেন, মেয়ের তিনটি ড্রেস কিনলে তিন জোড়া জুতা কিনতে হয়। আবার এর সঙ্গে মিলিয়ে সাজসজ্জার জিনিস কিনতে হয়।
এগুলো তো আগে ছিল না। এগুলোকে আমি অপব্যয়ই মনে করি। তারপরও নিরুপায় হয়ে মেনে নিতে হয়। সন্তানদের কিনে দিতে হয়। এর জন্য সংসারের ব্যয় সংকোচন করি। কখনো কখনো ধারদেনা করি। এভাবেই চলছে আমাদের কষ্টের সংসার। মানবজমিন