রফিকুজজামান রুমান
নিজের একটি ব্যক্তিগত অভ্যাসের কারণে তাঁর কাছে খুব একটা যাওয়া হয়নি। আমি সবসময় আমার কাজের ক্ষেত্র এবং সীমানা সম্পর্কে সচেতন থাকার চেষ্টা করি। সেই অভ্যাসের জন্যই অনেকের পরামর্শ স্বত্বেও স্যারের কাছে নিজের থেকে খুব একটা যাইনি।
সহকর্মীদের কেউ কেউ বলতেন, আপনার চিন্তা বা আইডিয়াগুলো স্যারের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। আমি সযত্নে বলতাম, আমার চিন্তা বা আইডিয়া নেওয়ার প্রয়োজন মনে হলে স্যারই আমাকে ডেকে নিবেন। আমি উপযাচক হয়ে নিজের আইডিয়া প্রতিষ্ঠা করার মানসিকতায় অভ্যস্ত নই।
তাই প্রায় দশ মাস স্যারের সঙ্গে পরিচয়ের এই সময়ে মাত্র দু’বার তার রুমে গিয়েছি। একবার আমার একটি প্রকাশিত লেখা স্যারকে দেখানোর জন্য। অন্যবার ক্যাম্পাসে একটি পাঠচক্র করবার অনুমতি চাওয়ার জন্য। সব মিলে স্যার সম্পর্কে লিখতে গেলে তাঁকে আরো জানবার যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সেখানে আমার অশেষ ঘাটতি।
কিন্তু কিছু মানুষ থাকে যাদেরকে দেখলেই আকাশের মতো মনে হয়, মনে হয় বিশাল এক সমুদ্র। এক নিমিষেই তার গভীরতা, প্রস্থটা এবং উদারতা আয়ত করা যায়। সমুদ্র সারাদিন ধরে দেখা আর এক মিনিটের জন্য দেখা- যেভাবইে দেখা হোক না কেন, সে সমুদ্রই; তার বিশালতা এবং গভীরতা বুঝতে কষ্ট হয় না।
প্রিয় আকরামুজ্জামান স্যার, আপনাকে খুব সামান্য দেখেও আপনার যে অসামান্য ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা, উদারতা, জ্ঞান, কর্মচঞ্চলতা, সততা দেখেছি তা এই নষ্ট সময়ে খুবই বিরল।আপনার চলে যাওয়াটাও তাই হয়ে থাকল কষ্টের এক অন্তর্ভেদী দেওয়াললিখন। এমন করে কেউ যায়! যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেও ঘণ্টা তিনেক বক্তব্য দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের চোখে আপনার জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা নিংড়ে দিয়ে কী এক মায়াবী স্বপ্নাঞ্জন এঁকে দিলেন!
আপনার এক একটি কথা তাদের কাছে অনুপ্রেরণার এক একটি বাতিঘর হয়ে দেখা দিল। কিন্তু সেই আপনিই কেমন করে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন অনন্ত এক আলোকের দিকে। কে বলেছে কবর অন্ধকার? আপনি হয়ত এখন সবচেয়ে আলোময়, সবচেয়ে স্নিগ্ধ কোমল অবিনাশী এক জগতে পরম মমতায় দিনযাপন করছেন আপনার প্রিয় রবের সান্নিধ্যে। আপনি নেই, কিন্তু আপনি কি জানেন, আপনার না-থাকাটা আমাদের জন্য কতোটা কষ্টের?
আপনি কি জানেন, আপনার মৃত্যু সংবাদ আমাকে জানাতে গিয়ে টেলিফোনে রেহানা ম্যাডাম কেঁদেই ফেললেন শিশুর মতো? আপনি কি জানেন, অফিসে বসে এই লেখা লিখতে গিয়ে কাঁদতে পারছি না বলে বুকে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছি বারবার?
আজ এই রৌদ্রোজ্জ্বল সকালেও ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে অন্ধকারের কেমন এক হাহাকারে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে আপনার সমস্ত সহকর্মীর হৃদয়গুলো। আপনার লাগানো ফুলগাছগুলো আপনার শূন্যতাকে চিৎকার করে জানান দিচ্ছে।
বিশ্বাস করুন স্যার,এই রং বেরং এর ফুলগুলো আপনাকে ছাড়া বড় বেমানান।রুমে বসেই জানালা দিয়ে ক্যাম্পাসের মাঠে আপনার কর্মচঞ্চলতা চোখে পড়ত। আপনাকে দেখতাম আর ভাবতাম,একজন মানুষ এতো কাজ কীভাবে করে। স্যার, আজ সারাদিনে জানালার দিকে তাকাইনি। অন্তত আজ জানালার ওপাড়ের শূন্যতা ধারণ করবার সামর্থ্য থেকে আমি বঞ্চিত।
বৃহস্পতিবারে চলে গেলেন। দুদিন আগে মঙ্গলবার শিক্ষকদের ট্রেনিং দিলেন। সেখানে কতো কথা বলে গেলেন! শিক্ষকদের মধ্যে আমিই একটু বেশি সরব ছিলাম। বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলাম। একটি গবেষণা ইউনিট প্রতিষ্ঠা করার দাবি করলাম। আপনি রাজি হলেন। এক পর্যায়ে কথা প্রসঙ্গে বললাম, আপনি তো সবই পেয়েছেন। আপনার জীবনে আর কী পাওয়ার আছে? শুনে কী যে সেই অকৃত্রিম হাসি! এমন বাঁধভাঙ্গা পবিত্র কৃতজ্ঞ হাসি আপনাকে আগে কখনো হাসতে দেখিনি!
তখনই জানলাম আপনার নির্মোহ নির্লোভ জীবন যাপনের অসাধারণ উদাহরণ। জানালেন আপনার ঘরে কোনো টেলিভিশন নেই, নেই কোনো রেফ্রিজারেটর! দেখলাম আপনার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও খুবই সাদাসিধে ও “আনস্মার্ট।”
ভোগের এই সময়ে আপনার এমন মানসিকতা দেখে সেদিন শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছিলাম। একটি বিব্রতকর প্রশ্নও করেছিলাম। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আপনার একটি নির্ধারিত ক্লাস ছিল ট্রেনিং এর সময়টাতে। আপনি আগে থেকে তাদেরকে জানাননি যে ক্লাসটি হবে না। এটি ঠিক হলো কিনা?
আপনি কোনো রকমের ঘোরপ্যাঁচে না যেয়ে বলে দিলেন, না, এটি আমার ভুল হয়েছে। এ আপনার আর এক বিরল ঔদার্য। জবাবদিহিতাহীনতার এমন সংস্কৃতির মাঝেও আপনি নিজের সামান্য ভুলও স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করেন না।
একদিনেই বুঝে ফেলেছি, আপনাকে ছাড়া এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণহীন। সূর্যহীন আকাশ কার ভালো লাগে? বাদক ছাড়া বাঁশির কী মূল্য আছে? আপনি অনুপ্রেরণার বাদক হয়ে যে সুর সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা আর কোথায় পাব? মানারাত বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আপনার স্বপ্ন এবং সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলার সাক্ষী হয়ে আছে স্থায়ী ক্যাম্পাসের প্রতিকণা মাটি। দিনরাত এই ক্যাম্পাসে থেকে কাজ করেছেন, অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। স্বপ্ন বুনেছেন। অকর্মণ্যদের অযাচিত সমালোচনা সয়েছেন। তবু মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে যায়নি। কফি খেতে পছন্দ করতেন। কফির ধোঁয়ার মতো করেই সমস্ত আলস্য আর নেতিবাচকতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। “কাজ, কাজ আর কাজ”- এই স্লোগানকে উপজীব্য করে আশেপাশের সবাইকে উদ্দীপ্ত করেছেন।
বক্তব্য দিতেন ভালো। কিন্তু অন্য অনেকের মতো শুধু কথার ফুলঝুরির মধ্যেই নিজেকে আটকে রাখেননি। কথার সার্থক অনুবাদক হয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। মানারাতের এই স্থায়ী ক্যাম্পাস বড় বেশি ঋণী হয়ে থাকল আপনার কাছে। আপনাকে ছাড়া এই ক্যাম্পাসটি কল্পনা করতে গেলেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এ আমার কী হলো স্যার!
আপনি চলে যাওয়ার পরে আপনাকে এমন করে কাছের মনে হচ্ছে কেন? আপনাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি কাঁদছি কেন? আহারে, আবার যদি ফিরে আসতেন! যদি একটি বার বলতে পারতাম, দূরে থেকেও আপনার এতোটা ভক্ত হয়েছি বুঝতে পারিনি। স্যার, আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি।আপনি এক নীরব যাদুকর।
আপনার ভয়াবহ খবরটি যখন শুনলাম তখন আমি নিজেও অন্য একটি হাসপাতালে ব্যথা পেয়ে আহত হওয়া আমার চার বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে। ক্ষত জায়গায় দুটি সেলাই লেগেছে। ছেলেকে নিয়ে রাতে বাসায় ফিরে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো।
একদিকে কপালে ব্যান্ডেজ লাগানো এতোটুকু ছেলের মুখ, অন্যদিকে আপনার মেনে-না-নিতে পারা প্রস্থান- সব মিলে মনে হলো যেন দু:স্বপ্ন। ঘুম ভেঙ্গে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ঘুম ভাঙ্গে। বারবার ঘুম ভাঙ্গে। তবু কোনোকিছুই ঠিক হয় না। মনে হলো কেউ এখনি ফোন দিয়ে বলবে, খবরটা ভুল। আকরাম স্যার বেঁচে আছেন।
আপনার তুলনা আপনিই। প্রার্থনা করলাম, ছেলে যেন বড় হয়ে একজন ভালো মানুষ হয়। সে যেন একজন মীর আকরামুজ্জামান হয়। channelionline
লেখকঃ রফিকুজজামান রুমান, গবেষক ও কলামিষ্ট