অবশেষে সৌদি আরবের রাজ পরিবারের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব অনেকটা প্রকাশ্যে চলে এসেছে। মাত্র দিন কয়েক আগে বর্তমান সৌদি রাজা সালমান বিন আবদুল আজিজ তার ছেলে মুহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স বা তার উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত করেন।

একই সঙ্গে পূর্ববর্তী যুবরাজ মুহাম্মদ বিন নায়েফকে তার পদ থেকে অপসারণ করেন। ধারণা করা হচ্ছে মুহাম্মদ বিন নায়েফকে বর্তমানে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। এই অবস্থা নিয়ে যখন বিচার বিশ্লেষণ চলছে তখনই গত পরশু সৌদি প্রশাসনে ব্যাপক ধরপাকড় ও ওলটপালট করা হয়েছে।

ব্যবসায়ী বিলিনিয়র আলওয়ালিদ বিন তালালসহ ১১ যুবরাজ, চার মন্ত্রী এবং সাবেক আরও ১০ মন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনার জের না কাটতেই গতকাল ইয়েমেন সীমান্তের কাছে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হয়েছেন এক রাজপুত্র।

ঘটনার ধারাবাহিকতা মধ্যপ্রাচ্যের সবাইকে সৌদি আরবে নজর ফেরাতে তাড়িত করেছে। শুধু তাই নয়, গত পরশু সৌদি প্রশাসনে তোলপাড়ের আগে দাবি করা হয় ইয়েমেন থেকে ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করেছে দেশটির বিমান বাহিনী।

রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে এসব ঘটনা নিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর নেই। সৌদি বিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা বাণিজ্য উদারীকরণের মধ্য দিয়ে নতুন অর্থনীতিতে প্রবেশের রাজনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়া। বিপরীতে অন্যরা একে দেখছেন রাজপরিবারের ক্ষমতাকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব হিসেবে।

সবমিলে সৌদি রাজতন্ত্রের সংকটকেই সামনে এনেছেন তারা। বিশ্লেষকদের দাবি, অশীতিপর বাবা বাদশাহ সালমান কার্যত দেশের ক্ষমতা প্রিয় ছেলের হাতেই তুলে দিয়েছেন। তাকে দেশটির ‘ডি ফ্যাক্টো’ নেতা হিসেবে মনে করছেন সেখানকার জনগণ।

তারই ধারাবাহিকতায় যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে প্রধান করে শনিবার সৌদি বাদশাহ নিজে একটি দুর্নীতি দমন কমিটি গঠন করেন। যেখানে যুবরাজ চাইলে যে কাউকে গ্রেফতার করার এবং যে কারও ওপরে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফলে দুর্নীতি দমনের এই কমিটি যে তার পথের কাঁটা দমনে ব্যবহার করা হবে তা সহজেই অনুমেয়।

নতুন এই কমিটি গঠনের মাত্র করেক ঘণ্টার মধ্যেই ১১ জন রাজপুত্র গ্রেফতার ও ন্যাশনাল গার্ড এবং নৌবাহিনী প্রধানের পদেও রদবদল করা হয়।

অবশ্য মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের ডেভিড কির্কপ্যাট্রিক বলেছেন, সৌদি আরবের নির্বাহী রাজতন্ত্রের কোনো লিখিত সংবিধান নেই। কিংবা পার্লামেন্ট বা আদালতের দ্বারা সিদ্ধ কোনো বিধিও নেই। তাই দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখা এখানে খুবই কঠিন। তিনি বলেন, ‘জনগণের টাকা ও রাজপরিবারের সম্পদের সম্পর্ক এখানে প্রশ্নবিদ্ধ। অন্যান্য দেশ এটা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও দুর্নীতি নিয়ে কথা বলার বিষয়টি কঠিন। ’

এদিকে কনজারভেটিভ আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট এর স্কলার অ্যান্ড্রু বাওয়েন এই ঘটনাকে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

টুডের ওয়ার্ল্ডভিউকে তিনি বলেন, ‘শি জিনপিংয়ের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে শুধু কমিউনিস্ট পার্টির দুর্নীতিই কমানো হয়নি বরং নিজের অবস্থান শক্ত করার জন্য অনেক প্রতিপক্ষকেও দমন করা হয়েছে।

’ সৌদির ঘটনা শুধু দেশেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের দিকেও মনোযোগী দেশটি। একদিকে সম্পদশালী কাতারকে একঘরে করে রাখার মিশন চলা অবস্থাতেই দুদিন আগে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ আল হারিরিকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। এই অভিযোগ করেছে ইরান।

মজার বিষয় হলো হারিরির পদত্যাগের ঘোষণা করা হয়েছে সৌদি আরব থেকে। আর সৌদি আরব এর জন্য দায়ী করেছে ইরানকে। কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে লেবাননে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া গ্রুপ হিজবুল্লাহকে দমন করার উদ্দেশ্যেই এই পদত্যাগ ‘নাটক’ করা হয়েছে।

যুবরাজের ক্ষমতার একচ্ছত্রকরণ, রাজপুত্র-মন্ত্রীদের ধরপাকড় আর নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্যেই যুদ্ধকবলিত ইয়েমেন সীমান্তের কাছে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে এক রাজপুত্র নিহত হয়েছেন। তার নাম মানসুর বিন মাকরান।

তিনি সৌদি আরবের আসির প্রদেশের ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন।

 


Comments