প্রাথমিক মেধাবৃত্তি নিয়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে যোগ্য শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে অযোগ্যদের বৃত্তি পাইয়ে দেয়ার বহু অভিযোগ থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

তদন্তেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে প্রভাবশালীদের সন্তান ছাড়াও নিজের সন্তানদের বৃত্তি পাইয়ে দেয়ার অভিযোগের সত্যতা ধরা পড়েছে এসব শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

সচেতন অভিভাবকদের অভিযোগের পর বেশকিছু জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়লেও খুব কম ক্ষেত্রেই দোষীদের শাস্তি দেয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বৃত্তি বাতিল এবং দায়ী কর্মকর্তাদের বদলির মধ্যে শাস্তি সীমাবদ্ধ রেখেছেন দায়িত্বশীলরা।

প্রভাবশালীদের সন্তান ও বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত কেজি স্কুলের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পাইয়ে দিতেই দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া শুরু হয়। যুগান্তরের অনুসন্ধান এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে দুর্নীতির এ চিত্র পাওয়া যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০০৯ সালে সমাপনী পরীক্ষা চালুর পর মেধাবৃত্তি নিয়ে এ দুর্নীতি উপজেলা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে।

সূত্র বলছে, তদন্তে ধরা পড়ার পর অযোগ্যদের বাদ দিয়ে প্রকৃত মেধাবীদের বৃত্তি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ আমলে না নেয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে। এমন অবস্থায় ১৯ নভেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা শুরু হচ্ছে।

পিইসি পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এ বৃত্তি দেয়া হয়। পরীক্ষা নেয় ডিপিই। জানতে চাইলে ডিপিই মহাপরিচালক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘পরীক্ষা ও বৃত্তির বিষয়ে সাম্প্রতিক কিছু অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তদন্ত করেছি। তাতে কিছু অভিযোগের সত্যতা পেয়েছি। পরে কিছু বৃত্তি বাতিল করে নতুন শিক্ষার্থী নির্বাচন করা হয়েছে।

পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন চেয়ে ফাইল পাঠিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘দোষীদের শাস্তি না দেয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। এ বছরও এ ধরনের একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহীর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’

মহাপরিচালক জানান, এ সমস্যা মোকাবেলায় আমরা প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছি। সাধারণত এক উপজেলার উত্তরপত্র ওই জেলার অন্য উপজেলা মূল্যায়ন করে থাকে। পরে উত্তরপত্র পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট উপজেলায়।

এ বছর থেকে উত্তরপত্র মূল্যায়নের পর শুধু নম্বরপত্রসহ টেবুলেশন শিট পাঠাবে। এ ছাড়া অনিয়ম ঠেকাতে মনিটরিং জোরদার করা হবে। এরপরও কেউ অভিযুক্ত হলে বিভাগীয় শাস্তির পাশাপাশি তার নাম ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজশাহীর এক জেলা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিজের মেয়েকে জিপিএ-৫ পাইয়ে দেয়ার অভিযোগের প্রমাণও মেলে তদন্তে। গত ১১ এপ্রিল ডিপিইর জারি করা প্রজ্ঞাপনে জালিয়াতির আশ্রয় নেয়ার বিষয়টি স্বীকারও করা হয়।

এতে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের সমাপনী পরীক্ষার ভিত্তিতে রাজশাহীর বোয়ালিয়া উপজেলায় প্রাথমিক বৃত্তির তালিকাবদ্ধ ৬২ জনের মধ্যে ৪০ জনের ক্ষেত্রেই জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। পরে তাদের বৃত্তি রহিত করা হয়।

পাশাপাশি সরকারের কাছ থেকে বৃত্তি হিসেবে নেয়া অর্থ ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে জমা দিতেও বলা হয় প্রজ্ঞাপনে। এ সংক্রান্ত নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জালিয়াতি করে বৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই বেসরকারি বা কেজি স্কুলের। এর মধ্যে শিমুল মেমোরিয়াল নর্থসাউথ স্কুলেরই আছে ১৩ জন।

গত বছরের সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলের ওপর সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ডিপিইতে খোলা চিঠি পাঠিয়েছিলেন।

তাতে তিনি দাবি করেন, পিইসি ফল তৈরিতে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে কিছু শিক্ষার্থীকে নম্বর কম-বেশি দিয়েছেন। ডিপিই ওই অভিযোগ আমলে নিয়ে জেলার ডিপিইওকে তদন্তের নির্দেশ দেন। গত ৪ এপ্রিল স্থানীয় ডিপিইও শেখ অহিদুল আলম তদন্ত প্রতিবেদন পাঠান ডিপিইতে।

তাতে তিনি বলেছেন, কিছু শিক্ষার্থীকে বৃত্তি পাইয়ে দিতে উপজেলায় বেশকিছু শিক্ষার্থীকে প্রাপ্ত নম্বরের চেয়ে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। উপজেলার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা এবং কম্পিউটার অপারেটরের যোগসাজশে এ ঘটনা ঘটেছে।

শেখ অহিদুল আলম বলেন, পরস্পর যোগসাজশে কিছু শিক্ষার্থীর নম্বর বাড়িয়ে লেখা হয়েছে, যাতে তারা বৃত্তি পায়। এটা ফৌজদারি অপরাধের শামিল।

জানা গেছে, পরে ওই উপজেলায় নতুন করে বৃত্তির ফল তৈরি করা হয়। গত ২২ মে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয় ডিপিইতে।

এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৬ সালের সমাপনী পরীক্ষার ফল তদন্ত করে বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীদের নাম অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বেশকিছু অনিয়ম হয়। পরে ৯৭ শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে ফল তদন্তের আবেদন করা হয়। যাচাইয়ের পর ৪৩ জনের ফল পরিবর্তন হয়।

যশোরের চৌগাছায় ঘটেছে আরেক কাণ্ড। উপজেলার পাতিঝিলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রোল নম্বরে প্রকৃত ছাত্রীর নামের পরিবর্তে অন্য ২ ছাত্রীর নাম লিখে তাদের বৃত্তি দেয়া হয়। গেজেটও জারি হয়ে যায়। টের পেয়ে প্রকৃত ছাত্রীরা অভিযোগ করলে তা সংশোধন করা হয়।

পাবনার সুজানগর উপজেলায় ২০১৬ সালের পরীক্ষায় ৫৮, ৫৯, ৬০, ৬৯, ৭০ ও ৭১ রোলধারীদের বৃত্তি থেকে বঞ্চিত করে অন্য ৬ জনকে দেয়া হয়। অভিভাবকদের চ্যালেঞ্জের মুখে পরে তা বাতিল করা হয়।

এ ছাড়া পটুয়াখালীতে নতুন করে একজনকে বৃত্তি দেয়া হয়। গাজীপুরের কালীগঞ্জে ১৯ জনের ফল রদ-বদল হয়। এর মধ্যে ভুয়া ৪ জনকে ট্যালেন্টপুল ও ৫ জনকে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি দেয়া হয়। পরে এসব বাতিল করে নতুন ৯ জনকে বৃত্তি দেয়া হয়েছে।

এ ছাড়া আরও ৭ জন নতুন করে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। তাদের আগে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি দেয়া হয়েছিল। অপর ৩ জনকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি দেয়া হলেও পরে সাধারণ গ্রেডে দেয়া হয়। এভাবে বৃত্তি নিয়ে অনিয়মের আরও বেশকিছু অভিযোগ আছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, রাজশাহীর বোয়ালিয়া উপজেলার ৪০ জনের বৃত্তি বাতিল করে নতুনদের বৃত্তি দেয়ার ব্যাপারে গত ৯ এপ্রিল ডিপিই মহাপরিচালক ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল চিঠি পাঠিয়েছেন। সেটি পর্যালোচনা চলছে। এ ব্যাপারে পরবর্তী করণীয় শিগগির জানিয়ে দেয়া হবে।

গত ১৬ জুলাই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ঢাকার দুই সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করা হয়।

তাতে ওই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের সমাপনী পরীক্ষার খাতা ঘষামাজাসহ অন্যান্য অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। পাশাপাশি তাদেরকে তৃতীয়বারের মতো শুনানিতে উপস্থিত হতে নির্দেশ দেয়া হয়।

ডিপিইর একজন কর্মকর্তা জানান, প্রায় প্রতিবছরই বিভিন্ন উপজেলায় সমাপনী পরীক্ষা এবং বৃত্তি নিয়ে নানা দুর্নীতি ও অনিয়ম হচ্ছে। ধরা পড়লে ‘ভুল’ হয়েছে বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করে থাকে সংশ্লিষ্টরা। এখানেই শেষ নয়, ভুয়া বৃত্তি বাতিলের পর রাজশাহী, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন উপজেলায় আদালতে মামলা দায়েরের ঘটনাও ঘটেছে।

 


Comments