সন্তানকে ডাক্তারি পড়াতে নীতিহীন পথে পা বাড়িয়েছেন কতিপয় বিত্তবান অভিভাবকও। বিবেক-বিবেচনার সবটুকু বিসর্জন দিয়ে অধ্যবসায় আর পরিশ্রমের চিরচেনা পথ ফেলে তারা শেষমেশ প্রশ্ন ফাঁসচক্রের দ্বারস্থ হয়েছেন। মোটা অংকের টাকায় কিনছেন প্রশ্নপত্র। উদ্দেশ্য সরকারি মেডিকেলে ভর্তি নিশ্চিত করা।

অবিশ্বাস্য হলেও এমন বাস্তবতার মুখোমুখি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

২০ অক্টোবর ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াত চক্রের ১৪ সদস্যকে গ্রেফতারের পর অভিভাবকদের পথভ্রষ্টতার এমন তথ্য মেলে। সিআইডির হাতে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৬ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

এরই সূত্র ধরে এক ছাত্রের বিত্তবান অভিভাবককে (বাবা-মা) শনাক্ত করে পুলিশ। তারা মেডিকেল ভর্তির প্রশ্ন কেনেন ১১ লাখ টাকায়। এ টাকা তুলে দেন প্রশ্নপত্র জালিয়াত চক্রের মূল হোতা অলিভ বিশ্বাসের হাতে।

সিআইডি সূত্র জানায়, এভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে সন্তানকে ডাক্তার বানাতে চাওয়া আরও বেশ কয়েক বিত্তবান অভিভাবককে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদেরও আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। এছাড়া জালিয়াতির মাধ্যমে এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন এমন ১২০ ছাত্রকে শনাক্ত করা হয়েছে।

এদিকে ঢাকায় প্রশ্ন ফাঁসচক্রের গডফাদার হিসেবে চিহ্নিত অলিভ বিশ্বাস বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) কর্মকর্তা বলে নিশ্চিত হয়েছে সিআইডি। তিনি বিকেএসপির সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তা। সিআইডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকায় প্রশ্ন ফাঁসচক্রের আরও কয়েক সদস্য বিকেএসপিতে আছেন।

এর মধ্যে একজন পরিচালককেও নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। ওই পরিচালক অলিভ বিশ্বাসকে ঢাকা থেকে পালাতে সহায়তা করেন। পুলিশের হাতে জালিয়াত চক্রের ১৪ সদস্য গ্রেফতারের পর পরই অলিভ বিশ্বাস ঢাকার বাইরে পালিয়ে যান। বিএকেএসপির একজন পরিচালক অলিভের মোবাইল ফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে তাকে সরে পড়তে বলেন।

সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিনহাজুল ইসলাম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসচক্রের সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড়া হবে না।

প্রশ্ন ফাঁসকারীদের সঙ্গে সঙ্গে যারা ফাঁস প্রশ্নপত্র কিনেছেন তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। কেননা আইনের দৃষ্টিতে তারাও সমান দোষে দোষী।

সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, অনলাইনে মোবাইল ফোন ও নানা ধরনের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস বিক্রি করেন এমন লোকও প্রশ্নফাঁস প্রক্রিয়ায় জড়িত। এমন একজন ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছে সিআইডি- যিনি প্রশ্ন ফাঁসে ব্যবহৃত উচ্চ প্রযুক্তির গোপন ডিভাইস বিদেশ থেকে আমদানির পর অলিভ বিশ্বাসের কাছে বিক্রি করতেন। ইতিমধ্যে তাকে গোয়েন্দা জালে আটকে ফেলা হয়েছে।

সূত্র জানায়, প্রশ্ন ফাঁসচক্রের গডফাদার অলিভ বিশ্বাসের কয়েকটি ব্যাংক হিসাবে বিপুল অংকের টাকার হদিস পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা জমা পড়েছে পূবালী ব্যাংকের বিকেএসপি শাখায়। পালিয়ে যাওয়ার আগে গত সপ্তাহেই অলিভ বিশ্বাস তার এই অ্যাকাউন্ট থেকে ২০ লাখ টাকা তোলেন।

সিআইডির অনুরোধে ইতিমধ্যে তার দুটি ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া অলিভ যাতে বিদেশে পালাতে না পারেন সেজন্য ইতিমধ্যে তার পাসপোর্ট নম্বর লক করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ।

সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত ৪টি স্তরে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। প্রথমত সরকারি প্রিন্টিং প্রেসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যক্তিগতভাবে এই ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে জড়িত।

পরবর্তী ধাপগুলোতে পরীক্ষা কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পরীক্ষার দিন দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং শেষ ধাপে রয়েছে পরীক্ষার্থী হিসেবে ছদ্মবেশী প্রশ্ন ফাঁসচক্রের সদস্যরা।

প্রশ্ন ফাঁসে ব্যবহৃত হচ্ছে উচ্চ প্রযুক্তির ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস। এছাড়া প্রশ্ন ফাঁসের পর উত্তরপত্র তৈরি করে যথাস্থানে দ্রুত সরবরাহে আরেকটি গ্রুপ কাজ করে।

 


Comments