পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০ ব্যাংকের লভ্যাংশ বা মুনাফার পরিমাণ ২০০৯ ও ২০১০ সালের পর থেকে অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজার উত্থানের কারণে ২০০৯ ও ২০১০ সালে আগের বছরগুলোর তুলনায় বেশি মুনাফা করেছিল।
এরপর বাজার ধ্বসের কারণে ব্যাংকগুলোর মুনাফাও কমে যায়। এরপর ২০১১১ ও ২০১২ সাল থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি হারে বাড়তে শুরু করায় এ খাতে ব্যাংকগুলোকে বড় অংকের সঞ্চিতি (ব্যাংকের খরচ) রাখতে হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর মুনাফা অনেক কমে গেছে।
তালিকাভুক্ত ৩০ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০৬ থেকে ২০০৮ সালে ব্যাংকগুলোর গড় লভ্যাংশের হার ছিল ২৭ থেকে ২৮ শতাংশের মধ্যে। ২০০৯ সালে পুঁজিবাজার চাঙ্গা হতে শুরু করায় ব্যাংকগুলোর মুনাফাও বাড়তে থাকে।
এ বছর ব্যাংকগুলোর গড় লভ্যাংশ ছিল ৩১ দশমিক ২৪ শতাংশ। ২০১০ সালে ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশের হার বেড়ে ৩২ দশমিক ২০ শতাংশে উঠে আসে। এরপর বাজার ধ্বসের সাথে সাথে ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশের হার কমতে থাকে।
২০১১ সালে ব্যাংকগুলোর গড় লভ্যাংশের হার ২৫ দশমিক ৭৪ শতাংশে নেমে আসে। এ সময়ে খেলাপি ঋণের বোঝাও বেশি হারে বাড়তে শুরু করে ব্যাংকিং খাতে। ফলে ২০১২ সালে ব্যাংকগুলোর গড় লভ্যাংশের হার এ যাবত্কালের সর্বনিম্ন ১৪ দমমিক ৯১ শতাংশে নেমে আসে। ২০১৩ সালে ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশের হার ছিল ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ।
২০১৪ সালে ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশের হার ছিল ১৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ২০১৫ সালে লভ্যাংশের হার ছিল ১৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
আর সর্বশেষ ২০১৬ সালে ব্যাংকগুলোর গড় লভ্যাংশের হার ১৭ দশমিক ৪৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়তে থাকলেও শেয়ারবাজার চাঙ্গা হওয়ার সাথে সাথে ব্যাংকগুলোর মুনাফাও বাড়তে শুরু করেছে।
একাধিক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে দিন দিন খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়ছে। ব্যাংকগুলোতে জমে আছে অতিরিক্ত তারল্যও। এরপরও এখন বেশিরভাগ ব্যাংকের আয় কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে। ব্যংকগুলো মূলত ভোক্তা ঋণসহ অন্য খাত থেকে আয় বাড়াচ্ছে।
পাশাপাশি শেয়ারবাজার থেকেও ব্যাংকগুলোর আয় বেড়েছে। তাই অতিরিক্ত তারল্যের নেতিবাচক প্রভাব বুঝা যাচ্ছে না। তাছাড়া খেলাপি ঋণের বোঝা সরকারি ব্যাংকগুলোতেই বেশি। তাই বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে এর প্রভাব তুলনামূলক কম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। যা বিতরণ হওয়া ঋণের ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
এ সময়ে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ১ লাখ ৩১ হাজার ৬৯০ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৩৮ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা খেলাপী হয়ে গেছে। অর্থাত্ সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ২৯ দশমিক ২৫ শতাংশই খেলাপী হয়ে গেছে।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ৫ লাখ ৬৮ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপী ঋণের পরিমান ৩৩ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। বিদেশি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণ ২ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। এছাড়া রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দুই ব্যাংকের খেলাপী ঋণ ৫ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা জানিয়েছে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন রাখতে হয়। ফলে ব্যাংকগুলোর ব্যয় বেড়ে যায়। এতে ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ঋণ শ্রেণীকরণের (খেলাপী) তিনটি পর্যায় রয়েছে।
তা হলো নিম্নমান, সন্দেহজনক এবং মন্দ বা ক্ষতি। এই তিনটি পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ নিম্নমানের ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ প্রভিশন, ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে হলে সন্দেহজনক ঋণ, যার বিপরীতে ৫০ শতাংশ প্রভিশন এবং ৯ মাসের বেশি হলে তাকে মন্দ বা ক্ষতি মানে বিবেচিত হয়, এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়।
এদিকে খেলাপি ঋণের পাশাপাশি ব্যাংকিং সেক্টরে প্রচুর অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। কিছু ব্যাংকের তারল্য সংকট থাকলেও অনেক ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্যের কারণে তাদের অর্থ ব্যবস্থাপনায় ব্যয় বাড়ছে। কারণ অতিরিক্ত তারল্যের এ অর্থ ঋণ দিতে না পারলেও তার পেছনে আমানতের সুদ ঠিকই গুণতে হচ্ছে।