সদ্য প্রয়াত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসন থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হক। সর্বশেষ গত ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।

তিনি ছিলেন সততার মূর্ত প্রতীক। অর্থ-প্রাচুর্য কোনো কিছুতেই মোহ ছিল না তার। সবসময় সাধারণ মানুষ আর এলাকার উন্নয়ন নিয়েই ছিল তার সব ভাবনা, চিন্তা, চেতনা। তার জীবনযাত্রা ছিল একেবারেই সাদামাটা। তিনি সবসময় বলতেন দুনিয়ার চাকচিক্য থাকবে না, একদিন সবকিছুর হিসাব দিতে হবে। তার নিজ গ্রাম নাসিরনগর উপজেলার পূর্বভাগ ইউনিয়নের পূর্বভাগ গ্রামের উত্তরপাড়ায় রয়েছে দুটি টিনের ঘর।

পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এ দুটি টিনের ঘরই তার সম্পদ। দীর্ঘদিনের পুরনো দুই ঘরের একটিতে থাকতেন মন্ত্রী আর অন্যটি ছিল তার বৈঠকখানা। গতকাল সকালে মন্ত্রী ছায়েদুল হকের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, পুরনো দুটি টিনের ঘরে শুধু দুটি খাট ও কাঠের কিছু ফার্নিচার এবং কয়েকটি প্লাস্টিকের চেয়ার পড়ে আছে।

বাড়িতে এলে ওই টিনের ঘরে পুরনো খাটেই ছায়েদুল হক ঘুমাতেন বলে জানিয়েছেন তার নিকট আত্মীয়রা।
ছায়েদুল হকের চাচাতো ভাই আবদুল বাছির বলেন, অর্থ-বিত্ত নিয়ে তার কোনো ভাবনা ছিল না। আমাদের শুধু বলতেন একদিন সবকিছুর হিসাব দিতে হবে। তিনি কখনো অন্যায় কাজ করেননি। মন্ত্রী হয়েও সবসময় সাধারণ মানুষের মতো চলাফেরা করেছেন।

গ্রামের মানুষদের তিনি বলতেন আমি এমপি-মন্ত্রী না, আমি তোমাদের ছায়েদুল হক। ছায়েদুল হকের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক বানেশ্বর দেবনাথ বলেন, ৫১ বছর ধরে আমি ছায়েদুল হককে চিনি। আজ পর্যন্ত আমি তার কোনো দোষ খুঁজে পাইনি। ছায়েদুল হকের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী ও নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রাফি উদ্দিন বলেন, নাসিরনগরে ছায়েদুল হকের বিকল্প আর কোনো নেতা নেই। বর্তমান সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি করে প্রচুর অর্থের মালিক হওয়ার অভিযোগ থাকলেও মন্ত্রী ছায়েদুল হক ছিলেন একেবারেই ভিন্ন।

সততার মূর্ত প্রতীক হিসেবে সাধারণ মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নেন মাটি ও মানুষের এই নেতা। হাওর বেষ্টিত নাসিরনগর উপজেলার সার্বিক উন্নয়নে জড়িয়ে আছে তার নাম। জেলা সদরের সঙ্গে নাসিরনগরের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপন তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের এক মাইলফলক। উল্লেখ্য, ছায়েদুল হক ১৯৪২ সালে পূর্বভাগ ইউনিয়নের পূর্বভাগ গ্রামের উত্তরপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের খ্যাতনামা এ আইনজীবী ১৯৭৩, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ এবং ২০১৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে চট্টগ্রাম বিভাগে আওয়ামী লীগের ফল বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি বিজয়ী হয়ে চমক দেখিয়েছিলেন।

চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন মন্ত্রী ছায়েদুল হক : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সৎ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মোহাম্মদ ছায়েদুল হকের জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় উপজেলার আশুতোষ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রীয় সালাম ও গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এ সময় বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। লাল-সবুজের জাতীয় পতাকায় মুড়ে দেওয়া হয় কফিন। পরে সেখানে তার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

জানাজায় অংশ নেওয়ার জন্য মানুষের ঢল নামে। প্রায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করেন। এতে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও সর্বস্তরের মানুষ জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। জানাজা শেষে ছায়েদুল হকের প্রতি নাসিরনগরে আওয়ামী পরিবারসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের নানা শ্রেণিপেশার মানুষসহ সর্বস্তরের নাগরিক ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানান। সর্বজনশ্রদ্ধেয়, সৎ মানুষ হিসেবে খ্যাত প্রয়াত মন্ত্রী ছায়েদুল হক সবার ভালোবাসা ও অশ্রুনয়নে চির বিদায় নিলেন। পরিবারের পক্ষ থেকে প্রয়াত মন্ত্রীর একমাত্র পুত্র চিকিৎসক এ এস এম রায়হানুল হক জানাজায় অংশ নেওয়া সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

জানাজায় অংশ নেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক এমপি, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম (অব.), পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী, সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা, আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সফিকুল আলম এমএসসি, মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. নজরুল আনোয়ার, জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ একে একরামুজ্জামান, সাবেক উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি মঈনুদ্দিন মঈন, সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন, সহ-সভাপতি তাজ মোহাম্মদ ইয়াসিন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা এম এ করিম, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ডা. রাফিউদ্দিন আহমেদ, উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এটিএম মনিরুজ্জামান সরকার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. লিয়াকত আলী, সরাইল উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল উদ্দিন ঠাকুর, সরাইল আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শিউলী আজাদ প্রমুখ। জানাজা শেষে তার জন্মস্থান উপজেলার পূর্বভাগ হাই স্কুল মাঠে বাদ জোহর তৃতীয় দফা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

পরে পারিবারিক কবরস্থানে পিতা-মাতার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। এর আগে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সকাল সাড়ে ৯টায় ছায়েদুল হকের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গার্ড অব অনার প্রদান করে ঢাকা জেলা প্রশাসন। ছায়েদুল হকের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। জানাজায় মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, জাতীয় সংসদের সদস্য, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আশপাশের অধিবাসীরাও অংশ নেন।

 


Comments