বয়স নব্বই পেরিয়েছে। এরপরও নিজে সাইকেল চালিয়ে গ্রামে গ্রামে বাড়ি গিয়ে নারী-পুরুষ-শিশুদের হাতে পৌঁছে দেন প্রয়োজনীয় ওষুধ। তিনি জহিরন বেওয়া।
তিস্তা বিধৌত উত্তরের জেলা লালমনিরহাটের আদিতমারী কিংবা এর আশপাশে গেলেই চোখে পড়বে-অশীতিপর এক বৃদ্ধা নিজে সাইকেল চালাচ্ছেন!
চিকিৎসা সম্পর্কে কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন জহিরন।
সম্প্রতি লালমনিরহাট টু আদিতমারী সড়কে তার দেখা মেলে। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে হাসিমুখে মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন এই নারী।
স্থানীয় লোকজন জানান, নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষের ‘চিকিৎসক’ জহিরন বেওয়া গত ৪৪ বছর ধরে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছেন।
প্যারাসিটামলসহ নানা প্রাথমিক ওষুধের পাশাপাশি অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুদেরও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরামর্শ দিয়ে আসছেন তিনি।
এলাকায় বিধাব জহিরন এতোটাই জনপ্রিয় যে, স্থানীয় লোকজন তার পরিচয় না জানলেও ‘বাংলার নানি’ হিসেবে সবাই এক নামে চেনেন। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে সাইকেলে চালিয়ে এ গ্রামে ও গ্রামে গরিব মানুষকে স্বাস্থ্য পরামর্শ দেন তিনি।
আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের কমলাবাড়ি গ্রামের মৃত সৈয়দ আলীর স্ত্রী জহিরন বেওয়া।
তিন ছেলে ও দুই মেয়ের জননী তিনি। স্বামী ২০০৩ সালে চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
জহিরন বলেন, ছেলে-মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। স্বামী মারা গেছেন। পরপারে চলে গেছে বড় ছেলে দানেশ আলীও। এখন ঘুরে ঘুরে মানুষকে অসুখ-বিসুখের প্রাথমিক চিকিৎসার পরামর্শ দিই।
‘তবে জটিল কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিই। কখনও কখনও জটিল রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যেতেও সহযোগিতা করি। ’
তিনি জানান, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে একটি ৬ মাসের প্রশিক্ষণ কোর্স করেছিলেন। এরপর থেকে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি এলাকায়।
‘আগে গ্রামে গ্রামে রোগীদের বাড়ি যেতাম। সেই অভ্যাসটা এখনও রয়ে গেছে। মরার আগে তা ছাড়তে পারবো বলেও মনে হয় না। ’
স্থানীয় আদিতমারী উপজেলা সদরের কালীগঞ্জ সড়কের বাসিন্দা হাসান ফারুক বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমি নানিকে দেখছি প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে গ্রামে-গঞ্জে মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
এর জন্য তিনি কোনো টাকা-পয়সা নেন না। ওষুধ দিলে তাও আবার বাজারে যে দাম সেই দামেই নেন। আবার গ্রামের গরিব লোকদের কাছ থেকে ওষুধের টাকাও নেন না।
আদিতমারী ডিগ্রি কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক খোরশেদ আলম সাগর বলেন, গর্ভবতী মায়েদের চিকিৎসা পরামর্শ দেন জহিরন বেওয়া। স্বাস্থ্য বিষয়ে তার প্রশিক্ষণ রয়েছে। ধাত্রী বিদ্যায়ও অভিজ্ঞ তিনি।
‘তবে নবজাতক ও মা কিংবা অন্যান্য কাউকে পরামর্শ দিয়েও কোনো সময় তাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেন না। মাঝে মাঝে ওষুধও ফ্রি দিয়ে দেন। ’
‘বাংলার নানি’ জহিরনের কাছ থেকেই কৃমির ওষুধ নিচ্ছিলেন স্থানীয় মহিষখোচা গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আবদুল আলীম।
তার মতে, ‘জহিরন খালা ডাক্তার না, ঠিক, কিন্তু তার অভিজ্ঞতা অনেক। তার পরামর্শ নিয়ে আমরা ছোট-খাট রোগ থেকে মুক্তি পাই। ’
এই রোগীর সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে জহিরন জানালেন, তার আদি ভিটা টাঙ্গাইলে। সেখানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ হয়েছিল তার। এরপর পরিবারের সঙ্গে লালমনিরহাট চলে আসেন।
আলাপচারিতায় জানালেন, দৈনিক অন্তত ৭-৮টি গ্রামের পঞ্চাশটিরও বেশি বাড়িতে যান। প্রতি মাসে আশপাশের ২৫-৩০টি গ্রামে যান তিনি। এতে আয়ও হয় মোটামুটি।
তার ভাষ্য, যা আয় হয় তা দিয়েই চলে যায়। দৈনিক ওষুধ বিক্রি থেকে কমপক্ষে দেড়শ টাকা হয়। ছেলে-নাতিরা নিষেধ করলেও অভ্যাসের বসে কাজটি ছাড়তে পারি না।
এক প্রশ্নের উত্তরে জহিরনের হাস্যেজ্জল উত্তর, ‘কবে অসুখে পড়েছিলাম মনে নাই। আল্লাহর রহমতে রোগ-বালাই ধরে না আমাকে। ’
এরপরও বৃদ্ধা দাদিকে নিয়ে বেশ চিন্তিত নাতি মো. সিদ্দিক আলী। বললেন, প্রতিদিনই সাত সকালে সাইকেল নিয়ে দাদি বের হয়ে যান। এ নিয়ে একুট চিন্তা তো আছেই।
‘বয়স হলেও নানির শারীরিক কোনো অসুস্থতা নেই। দিব্বি সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়ান। মানুষের উপকার করছেন ভেবে আমাদেরও ভালো লাগে। ’
মোবাইল ফোনে জহিরনের ছোট ছেলে মো. তোরাব আলী জানান, কিছু জমিজমা আছে। এগুলো আবাদ করে চলে যায়। মায়ের কাজ করারও প্রয়োজন হয় না।
‘তাকে (জহিরন) অনেকবার বলেছি কাজ করার দরকার নেই। কিন্তু তিনি শোনেন না। উত্তরে তিনি বলেন, তার কাজতো শুধুমাত্র নিজের জন্য নয়। সমাজের জন্যও। ’
জহিরনের ছেলে বলেন, আমরাও আর না করি না। এই কাজ করে যদি উনি শান্তি পান আমাদের কোনো বারণ নেই।
সব শেষে জহিরনও বললেন, সমাজে সাধারণ মানুষগুলোর পাশে থেকে থেকেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান তিনি। - বিএসএস