তখনও ভোর। শীতের হালকা কুয়াশায় বাঁশের টুকরি আর কোদাল হাতে মানুষগুলো ভিড় জমাচ্ছেন ‘মানুষের হাটে’। প্রাচীনকালে ও মধ্যযুগে সমাজে মানুষ কেনাবেচার হাট বসত। সেই দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে কবেই।
কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের নির্মম আঘাতে নিন্ম আয়ের মানুষগুলো দুই বেলা রুটিরুজির জন্য আজও নিজেকে বেঁচে দেন মানুষের হাটে।
নগরীর রায়েরবাজার মুক্তি সিনেমা হল চত্বরে প্রতিদিন সকালে বসে মানুষ ক্রয়-বিক্রয়ের হাট। রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি, স্যানিটারি মিস্ত্রি, দিনমজুরসহ নানা পেশার শ্রমজীবী মানুষে সরগরম হয়ে ওঠে এই বাজার।
শ্রমের এই বাজারে শ্রমিক কিনতে আসেন মালিকরা। অনেক শ্রমজীবী বিক্রি হলেও অনেকে থেকে যান অবিক্রীত।
কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে ভেঙে যাওয়া ঘর, রায়েরবাজার বেড়িবাঁধের সাদেক খান পেট্রুলপাম্পের পাশে ভাড়া বাড়িতে এসে আবার গড়েছেন এনামুল হক। সংসার চালানোর জন্য নিজেকে প্রতিদিন বিক্রি করতে আসেন মানুষের হাটে, কোনো কোনো দিন থেকে যান অবিক্রীত।
দিনমজুর এনামুল হকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আট বছর আগে ব্রহ্মপুত্র নদে বাড়ি ভেঙে যাওয়ায় ঢাকায় চলে আসি। যখন যে কাজ পাই সেই কাজ করি। সন্তানরা নিজেরাই চলতে পারে না, আমাদের কী দেখবে?
তাই প্রতিদিন কামলা দিতে হয়। কামলার হাটে দাম একটু বেশি পাই। কেউ কিনলে, কোনো দিন ৫০০ আবার কোনো দিন ৬০০ টাকা থাকে। বেচা না হলে সেদিন রিকশা চালাই।’
ধানমণ্ডির মধুবাজারের বন্ধন ভিলার মালিক মাহবুবুল আলম মানুষের হাটে এসেছেন রংমিস্ত্রি কিনতে। তিনি বলেন, ‘বাড়ির সামনের দেয়ালে রঙ করতে হবে, তাই এই বাজারে রংমিস্ত্রি কিনতে এসেছি।
শ্রমিকের দাম একটু বেশি হলেও এখানে সহজে কাজের লোক পাওয়া যায়। একজন রংমিস্ত্রি নিয়েছি ৭০০ টাকায় আর দু’জন সহকারী মিস্ত্রি নিয়েছি ১০০০ টাকায়।’
মানুষের এই হাটে বেচাকেনা চলে ভোর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত। দামদর ঠিক হয়ে গেলে শ্রমজীবী মানুষগুলো রওনা হন মালিকের গন্তব্যে। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ঘাম ঝরিয়ে কাজ করেন কঠোর পরিশ্রমী মানুষগুলো।
রায়েরবাজারের কাঠমিস্ত্রি শাহাদত হোসেনের জীবনও যেন জড়িয়ে আছে মানুষের হাটের সঙ্গে। তিন বছর ধরে এই বাজারে বিক্রি হতে আসেন তিনি। মিস্ত্রির কাজের মজুরি কেমন জানতে চাইলে শাহাদত বলেন, ‘বাজারে মিস্ত্রির দাম ৭০০ টাকা আর শ্রমিক ও জোগালের দাম একটু কম ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।’
এক যুগেরও বেশি আগে থেকে মুক্তি সিনেমা হলের সামনের এই মানুষের হাট বসে। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর টাউন হল ও বাসস্ট্যান্ড, হাজারীবাগ এবং রায়েরবাজার খেলার মাঠের পাশে মানুষের হাট বসে বলে জানান রায়েরবাজার ছাতা মসজিদ এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা বশির আলী।
নিয়মিত হাট বসলেও মানুষের হাটে নেই কোনো খাজনা, সমিতির ঝামেলা, হাট কমিটির চাঁদাবাজি। নিজের আপন গতিতেই চলে এই হাট।
শ্রমজীবী মানুষরা সেদিক দিয়ে শান্তিতে থাকলেও তাদের কাজের নিশ্চয়তা এবং জীবনের নিরাপত্তা অনিশ্চিত।