সৃজনশীল প্রশ্ন ♦ কার্যকারণ সম্পর্ক প্রমাণ পদ্ধতি
উদ্দীপকটি পড়ে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :
নাইম তার ছোট ভাই ফাহিমকে একটি অঙ্ক কষতে দেয়। নাইম বলল, একটি গাছে ২০টি পাখি ছিল। সেখান থেকে হঠাৎ করে ১৫টি পাখি উড়ে যায়। তাহলে আর কয়টি পাখি থাকবে? ফাহিম সহজেই বলে দিল ৫টি পাখি। নাইম তখন বলল, পাখি যতটা উড়ে যাবে, ততটা কমে যাবে।
ক) অপনয়ন কাকে বলে?
খ) ব্যতিরেকী পদ্ধতির অপপ্রয়োগে কাকতালীয় অনুপপত্তি ঘটে—ব্যাখ্যা করো।
গ) ফাহিমের উক্তিতে কার্যকারণ সম্পর্ক প্রমাণের কোন পদ্ধতির প্রতিফলন ঘটেছে?
ঘ) কার্যকারণ সম্পর্ক প্রমাণ পদ্ধতির আলোকে নাইমের উক্তিটির মূল্যায়ন করো।
উত্তর : ক) কোনো ঘটনার কার্যকারণ নির্ণয়ের সময় কারণের সঙ্গে সম্পৃক্তবিহীন অপ্রয়োজনীয় বিষয় বাদ দেওয়াকে অপনয়ন বলে।
খ) ব্যতিরেকী পদ্ধতির অপপ্রয়োগে কাকতালীয় অনুপপত্তি ঘটে। আমরা জানি, কারণ হচ্ছে কার্যের শর্তহীন, অপরিবর্তনীয় ও অব্যবহিত পূর্ববর্তী ঘটনা। কার্যকারণ সম্পর্ক স্থাপন ছাড়া কোনো পূর্ববর্তী ঘটনাকে পরবর্তী ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করলে তখন কাকতালীয় অনুপপত্তি ঘটে। যেমন পরীক্ষা শুরুর আগে কালো বিড়াল দেখায় কারো পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। এখানে কালো বিড়াল দেখাকে পরীক্ষা খারাপ হওয়ার কারণ বলা হয়েছে। মূলত পরীক্ষা খারাপ হওয়ার কারণ পড়ালেখা না করা, শারীরিক অসুস্থতা বা পরীক্ষায় লেখতে না পারা ইত্যাদির সমন্বয় বা পৃথক যেকোনোটি হতে পারে, কালো বিড়াল দেখা হতে পারে না। অন্যদিকে ব্যতিরেকী পদ্ধতি হচ্ছে পূর্ববর্তী ঘটনার উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির পার্থক্য। অর্থাৎ এখানে কালো বিড়াল না দেখলেই তার পরীক্ষা ভালো হতো। আসলে এটি সঠিক নয়। এই কারণে বলা যায়, ব্যতিরেকী পদ্ধতির অপপ্রয়োগে কাকতালীয় অনুপপত্তি ঘটে।
গ) ফাহিমের উক্তিতে কার্যকারণ সম্পর্ক প্রমাণের অন্যতম পদ্ধতি পরিশেষ পদ্ধতির প্রতিফলন ঘটেছে।
পূর্বগ বা কারণের যে অংশ সম্পর্কে আমাদের জানা আছে, সে অংশটুকু বাদ দিলে পূর্বগ বা কারণের ক্ষেত্রে যা অবশিষ্ট থাকবে, তাকেই অনুগ বা কার্যের অবশিষ্টাংশের কারণ বলে বিবেচনা করতে হবে—এটিই হচ্ছে পরিশেষ পদ্ধতি। অর্থাৎ বিয়োগ পদ্ধতির মাধ্যমে ফলাফল বা কারণ নির্ণয়ের পদ্ধতিই হচ্ছে পরিশেষ পদ্ধতি। উদ্দীপকে দেখা যায়, একটি গাছে ২০টি পাখি ছিল, যেখান থেকে ১৫টি উড়ে যায়। সবারই জানা আছে ১৫ সংখ্যক পাখি ২০ সংখ্যক পাখির অন্তর্ভুক্ত। আর এখানে ২০টি থেকে যখন ১৫টি চলে যায় তখন অবশিষ্ট আছে ৫টি। অর্থাৎ পূর্বগ ২০ এর যা অবশিষ্ট আছে তাই অনুগের অবশিষ্টাংশের কার্য অর্থাৎ উড়ে যাওয়া পাখির সংখ্যা। সুতরাং আমরা সহজেই বলতে পারি ফাহিমের প্রক্রিয়াটি পরিশেষ পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত।
যুক্তিবিদ মিল পরিশেষ পদ্ধতিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, কোনো ঘটনার যে অংশকে আরোহ পদ্ধতি প্রয়োগ করে অগ্রবর্তী ঘটনার কার্য বলে জানা গেছে, সেই অংশকে সব ঘটনা থেকে বাদ দিলে যা অবশিষ্ট থাকে, তা অবশিষ্ট অগ্রবর্তী ঘটনার কার্য। যেমন—পানিসহ একটি পাত্রের ওজন ১০ কেজি। জানা যায়, পাত্রের ওজন ১ কেজি। সুতরাং পানিসহ পাত্রের ওজন থেকে পাত্রের ওজন বাদ দিলে পানির ওজন পাওয়া যাবে ৯ কেজি। অর্থাৎ ১ কেজি বাদ দেওয়ার কারণেই ৯ কেজি পাওয়া যায়। মিলের মতে, এটি কোনো মৌলিক পদ্ধতি নয়, বরং ব্যতিরেকী পদ্ধতির একটি বিশেষ পরিবর্তিত রূপ।
ঘ) নাইমের উক্তিতে কার্যকারণ সম্পর্ক প্রমাণের অন্যতম পদ্ধতি সহপরিবর্তন পদ্ধতির প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।
একটি ঘটনার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যদি অন্য একটি ঘটনায়ও পরিবর্তন দেখা যায় তাহলে পূর্ববর্তী ঘটনাকে কারণ ও পরবর্তী ঘটনাকে কার্য বলে—এ পদ্ধতির নামই হচ্ছে সহপরিবর্তন পদ্ধতি। উদ্দীপকে দেখা যায়, নাইমের উক্তিতে এসেছে, পাখি যতটা উড়ে যাবে, ততটা কমে যাবে। অর্থাৎ এখানে পূর্ববর্তী ঘটনা ‘উড়ে যাওয়ার’ সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী ঘটনা ‘কমতে থাকা’র সম্পর্ক আছে। যদি একটি উড়ে যায় তাহলে একটি কমবে, দুটি গেলে দুটি কমবে। তাই বলা যায়, এটি সহপরিবর্তন পদ্ধতির একটি দৃষ্টান্ত। নিচে সহপরিবর্তন পদ্ধতির মূল্যায়ন করা হলো—
যুক্তিবিদ মিল উদ্ভাবিত কার্যকারণ সম্পর্ক প্রমাণের পাঁচটি পরীক্ষণমূলক পদ্ধতির মধ্যে সহপরিবর্তন পদ্ধতি একটি মৌলিক পদ্ধতি। সহপরিবর্তন শব্দের অর্থ পারস্পরিক পরিবর্তন। এ পদ্ধতি অনুসারে কারণের পরিবর্তন হলে কার্যেরও পরিবর্তন ঘটে। যেমন—তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে থার্মোমিটারের পারদস্তম্ভ বৃদ্ধি পায়, আবার তাপমাত্রা কমলে পারদস্তম্ভও নিচে নেমে আসে। অর্থাৎ তাপমাত্রাই পারদস্তম্ভের ওঠা-নামার কারণ।
সহপরিবর্তন দুই ধরনের হয়—ক) সরাসরি সহপরিবর্তন ও খ) বিপরীত সহপরিবর্তন। যখন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ঘটনা দুটি একসঙ্গে বাড়ে এবং একসঙ্গে কমে, তখন তাকে সরাসরি সহপরিবর্তন পদ্ধতি বলে। যেমন তাপমাত্রা বাড়লে পারদস্তম্ভ বাড়ে, কমলে পারদস্তম্ভ কমে। অন্যদিকে যদি ঘটনা দুটির মধ্যে একটি বাড়লে অন্যটি কমে বা একটি কমলে অন্যটি বাড়ে এমন সম্পর্ক থাকে, তাহলে সেটিকে বিপরীত সহপরিবর্তন বলে। যেমন পদের ব্যক্ত্যর্থ বাড়লে জাত্যর্থ কমে, ব্যক্ত্যর্থ কমলে জাত্যর্থ বাড়ে।
সহপরিবর্তন পদ্ধতিতে যেমন সুবিধা আছে, তেমনি অসুবিধাও আছে। সুবিধার মধ্যে যা দেখা যায় সেগুলো হচ্ছে—সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত পাওয়ার ক্ষেত্রে, বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠায় সহায়তা, কার্যকারণের পরিমাণগত দিক নির্ণয়ে সহায়তা প্রভৃতি। আবার অসুবিধার মধ্যে রয়েছে—এর প্রয়োগ ক্ষেত্রের সীমাবদ্ধতা, কারণ ও সহকার্য নির্ণয়ে জটিলতা, গুণগত পরিবর্তনের ব্যাখ্যা সম্ভব না হওয়া ইত্যাদি। আবার এ অপপ্রয়োগের কারণে বিভিন্ন অনুপপত্তিও ঘটতে দেখা যায়। যেমন দৃষ্টান্তের অনিরীক্ষণ অনুপপত্তি, কার্যকারণ সংক্রান্ত অনুপপত্তি এবং সহকার্যকে কারণ হিসেবে গ্রহণজনিত অনুপপত্তি।
তবে আমরা দৈনন্দিন জীবনে প্রায়ই সহপরিবর্তন পদ্ধতির মাধ্যমে কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা করি। এ জন্য বিভিন্ন অসুবিধা সত্ত্বেও এর গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।