বর্তমান শাক-সব্জীর উর্দ্ধমূল্যের বাজারে সবচে বেশী দাম বা অগ্নিমূল্যে বিক্রি হচ্ছে বাঙালীর জনপ্রিয় সুস্বাদু সব্জী লাউ। যুগ যুগ ধরে সাধারণ মানুষ যে সস্তা লাউ খেয়ে রসনা তৃপ্ত করতো, সে লাউ এখন ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।
এক সময় গরীব সাধারণ মানুষের সব্জী লাউ এখন ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সব্জীতে পরিণত হয়েছে। একটি সাধারণ আকৃতির লাউ বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকা দরে। কোন কোন লাউ ১০০-১১০ টাকা দরেও বিক্রি হচ্ছে। ছোটখাট যেনতেন আকারের একটি লাউও ৫০ টাকার নিচে কেনা যায় না।
এক কথায় বাজারে এখন লাউয়ের তীব্র সংকট বিরাজ করছে। বাজারে লাউ’র আমদানী আশংকাজনকভাবে কমে গেছে। বেশী টাকার লোভে এক শ্রেণীর খামারী চাষী লাউয়ের অগ্রীম বা গড়মৌসুম লাউয়ের চাষাবাদ, লাউয়ের চেয়ে লাউয়ের ডগা বিক্রিতে বেশী উৎসাহ এবং খরিপ মৌসুমের লাউ শীত মৌসুমে চাষাবাদের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সব্জী চাষীরা জানিয়েছে, বাংলাদেশে লাউয়ের মৌসুম শুরু হয় সাধারণত ভাদ্র-আশি^ন মাস থেকে। কার্তিক মাসের মধ্যভাগে হালকা কুয়াশা দেখা দিলে লাউ গাছে ফলন দিতে শুরু করে। বাজারে তখন আমদানী হতে থাকে শীতের মাছ, শোল, গজার ও টাকি।
চাষীরা শীতের সকালে হালকা কুয়াশা ভেজা লাউ বাজারে নিয়ে গেলে শহুরে চাকরীজীবী ও ব্যবসায়ীরা খুব আয়েশ করে লাউ কিনে নিতো। সাথে বাজার থেকে কিনে নিতো শোল, গজার ও টাকি মাছ। লাউয়ের সাথে শোল, গজার ও টাকি মাছের একটি রাসায়নিক মিল থাকায় বাঙালীরা এসব মাছ দিয়ে লাউ রান্না করে খেতো। এ ছাড়া গাঙের রুই ও কাতল, নলা মাছ দিয়েও লাউ রান্না করতো বাঙালীরা।
বর্তমানে মুরগীর এবং গরুর গোশত দিয়ে লাউ রান্না করে খেতে দেখা যায়। লাউকে ভাতের সম্পূরক খাদ্য হিসেবে মনে করা হতো। অর্থাৎ বাঙালীরা মৌসুমে নিয়মিত লাউ খেলে পরিবার প্রতি বছরে এক মণ চাল কম লাগতো।
সে সময় মৌসুমের বাইরে কেউ এই লাউয়ের চাষাবাদ করতো না। মৌসুমে লাউয়ের উৎপাদন এতো বেশী হতো যে, অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে গিয়ে লাউ একটি ফেলনা সব্জীতে পরিণত হতো। তখন বাজারে একটি লাউ ৫-১০ টাকায় বিক্রি হতো। চাষীরা লাউ বাজারে বিক্রি করতে না পেরে কাঁচি দিয়ে কেটে গরুকে খাওয়াতো। এখন আর সে সময় নেই। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে শাক-সব্জীর চাহিদা বেড়ে গেছে। সেই সাথে বেড়ে গেছে লাউয়ের চাহিদাও।
আর এই চাহিদার সুযোগ নিয়ে খামারী চাষী অগ্রিম লাউ চাষাবাদের দিকে ঝুকে পড়তে শুরু করে। তারা আষাঢ়-শ্রাবণ মাস থেকেই বিশেষ পদ্ধতিতে লাউ চাষাবাদ শুরু করে। ভাদ্র মাসেই বাজারে লাউ আমদানী হতে থাকে। সে সময় বাজারে মরা কার্তিকের টান শুরু হলে এ সুযোগ নিয়ে খামারী চাষী ও ফড়িয়ারা চড়া দামে বাজারে লাউ বিক্রি করে।
অগ্রীম লাউয়ের স্বাদ মৌসুমী লাউয়ের মতো হয় না। গৃহিনীরা জানিয়েছেন, ভাদুড়ে লাউয়ের চামড়া হয় শক্ত। ভিতরে বীচি হয় বড় বড়। স্বাদ একেবারেই পানসে। এই লাউগুলো হলো ভারত থেকে আমদানীকৃত সামার প্রলিফিক জাতের। চাষী না বুঝেই এসব খরিপ মৌসুমের লাউ আবার শীত মৌসুমেও রোপন করে। ফলে শীত মৌসুমে এসে খরিপ মৌসুমে লাউয়ের উৎপাদন কমে যায়।
এছাড়া বাজারে লাউয়ের চেয়ে লাউ গাছের ডগার চাহিদা অনেক বেশী থাকায় চাষী অতিরিক্ত সার পানি দিয়ে ভেজিটেটিভ গ্রোথ বা ডগার উৎপাদন বাড়ায়। দুটি ডগার একটি আটি বিক্রি হয় ৩০-৪০ টাকা দরে। লাউ উৎপাদন করতে যে সময় লাগে এ সময়ের মধ্যে ডগা বিক্রি করেই চাষী বেশী লাভবান হয়। প্রতি বছর অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে বাজার থেকে লাউ একেবারেই লাপাত্তা হয়ে যায়।
খুচরা বিক্রেতারা জানিয়েছে, পাইকারী বাজারগুলোতে লাউয়ের আমদানী খুবই কম। যা-ও আমদানী হচ্ছে তা পাইকারী ক্রেতারা বেশী দাম দিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোতে নিয়ে যাচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা যা পাচ্ছে তাও বিক্রি করছে চড়া দামে। বর্তমানে একটি ছোট লাউ বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ৫০ টাকা এবং একটি মাঝারী আকারের লাউ বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকা দরে।