বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের গ্রামের বাড়ি বগুড়ার গাবতলী। আর এ কারণেই বিভিন্ন নির্বাচনে বগুড়ায় বিএনপির ভোটের পাল্লা ভারী থাকে। কিন্তু জিয়াউর রহমানের বাপ-দাদার এই বাড়ি অবহেলিতভাবেই পড়ে আছে।

প্রত্যন্ত গ্রামের জীর্ণশীর্ণ এই বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ করে না কেউই। শুধু তাই নয়, দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় কয়েকবার বিএনপি থাকলেও কোনো উন্নয়ন হয়নি জিয়ার বাপ-দাদার এই ভিটেবাড়ির। বিএনপির রাজনীতি করে অনেকেই হয়েছেন এমপি-মন্ত্রী। হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিকও।

বানিয়েছেন দামি বাড়ি, কিনেছেন দামি গাড়ি। কিন্তু কখনো কেউ দলের প্রতিষ্ঠাতার বাড়িঘরের উন্নয়নে নজর দেননি। গ্রামবাসী বলছেন, জিয়াউর রহমান অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠাবান ছিলেন। নিজের বাড়ির উন্নয়ন করেননি। ব্যস্ত থাকতেন দেশের নানা কাজে। মাঝেমধ্যে জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী খালেদা জিয়া ও তাঁর সন্তানরা বাড়িতে এসেছেন।

খালেদা জিয়া তো একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনিও এ ব্যাপারে দৃষ্টি দেননি। অথচ জিয়াউর রহমানের বাড়ির আশপাশে অনেকেরই রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। বগুড়া জেলা শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে গাবতলী উপজেলার বাগবাড়ী নামক এক প্রত্যন্ত গ্রামে জিয়াউর রহমানের বাড়ির অবস্থান। আর এখানেই জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান জিয়া।

গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাগবাড়ী মোড় থেকে একটু দক্ষিণে সরোবর খালসংলগ্ন পশ্চিম পাশেই জিয়াউর রহমানের বাড়ি। বাড়িতে রোকেয়া বেগম নামে এক বৃদ্ধা তার ছেলেকে নিয়ে বসবাস করছেন।

বাড়ির সামনেই সংযুক্ত দুটি টিনের ঘর; যার প্রবেশমুখে অস্পষ্টভাবে লেখাসংবলিত একটি নেমপ্লেটে খোদাই অক্ষরে শহীদ জিউয়ার রহমান, মিসিরুন্নেছা জহুরা খাতুন, জিয়াবাড়ী, বাগবাড়ী, বগুড়া রয়েছে। বাড়ির ভিতরে পশ্চিম পাশে দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি এক তলা পাকা ঘর।

ছাদে এক পাশে একটি ছোট্ট কক্ষও রয়েছে। ওই পাকা ঘরের সম্মুখভাগেই লেখা ২২ শে আষাঢ় ১৩০২, ১৮৯৫। জানতে চাইলে রোকেয়ার ছেলে রফিকুল ইসলাম জানান, এটি বাড়ি নির্মাণের তারিখ।

তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় প্রতি বছরই জন্ম ও মৃত্যু দিবসে এ বাড়িতে জিয়ার নামে দোয়া-মিলাদ মাহফিল হতো। এখন আর হয় না। বাড়ির এমন অবস্থা যা দেখে কেউ কখনো বলবেন না এটি সাবেক একজন রাষ্ট্রপতির বাড়ি।

বাড়ির সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে গাছের ডাল-পাতা। পাকা ঘরটি সেই যে কবে রং করা হয়েছে তা দেখলেই বোঝা যায়। ঘরটির পেছনে পাকা ঘাটসহ একটি পুকুর রয়েছে। ঘরের উত্তর পাশে ছাপড়ার নিচে বাড়ি দেখাশোনা করা রোকেয়া বেগম গরু পালেন। বাড়ির সামনের অংশে অনেকটুকু খোলা জায়গা। তবে রোকেয়া বেগমরা থাকেন সামনের টিনশেড ঘরটিতে।

পাকা ঘরটির কক্ষগুলোয় কোনোমতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ঘরটির দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়ছে। ঘরের দরজায় সবসময়ই তালা দেওয়া থাকে। মাঝেমধ্যে খুলে তা পরিষ্কার করেন রোকেয়া ও তার ছেলে। জিয়ার বাড়ির উত্তর ও দক্ষিণে কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন বাড়ি রয়েছে।

এ সময় প্রতিবেশী শমসের আলী (৮০) বলেন, ‘চাকচিক্য বাড়ি করলি মানুষ বলিত্ত ক্ষমতায় আইসে নিজর বাড়ি বানাইচ্ছে।’ জিয়ার বাড়ির পুব পাশের সরোবর খালটি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালে এই এলাকার কৃষি জমিতে সেচের জন্য নিজেই খনন করেন।

এদিকে বাগবাড়ী মোড় থেকে একটু পুবে এগোলেই দেখা যায় জিয়াউর রহমানের নামে একটি কলেজ। কলেজ মাঠের উত্তর পাশে বড় আকৃতির একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। শহীদ জিয়া কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক আমিনুল হক তালুকদার বলেন, ‘আমার বাড়ি জিয়াউর রহমানের বাড়ির পাশেই। আমি ছোটবেলায় বহুবার দেখেছি জিয়াউর রহমানকে।’

তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের জন্ম এখানে হলেও জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন বাইরে। জিয়াউর রহমান এই গ্রামের বাগবাড়ী কে এম মাইনার স্কুলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে পড়েছেন।’ শহীদ জিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ফজলার রহমান বলেন, ‘সাবেক একজন রাষ্ট্রপতির বাড়ি এ রকম কোথাও দেখিনি। তিনি অতি সাধারণ মানুষ হওয়ায় বাপ-দাদার ভিটেবাড়ি এমন; যা অনেকটা অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে।’

অন্যদিকে জিয়াউর রহমানের বাপ-দাদার পূর্বপুরুষের বাড়ি ছিল একই উপজেলার পাশের মহিষাবান গ্রামে। ওই বাড়িতে গিয়েও দেখা যায় একই অবস্থা। বহু পুরনো জরাজীর্ণ একটি টিনশেড ঘর রয়েছে।

বাড়ির সামনে দুটি কবর। এর একটি গত বছরের ২৩ নভেম্বর মারা যাওয়া জিয়ার ছোট ভাই আহমেদ কামাল বিলুর। এ বাড়িতেও কেউ থাকেন না। ওসমান আলী মণ্ডল নামের একজন স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাড়িটি দেখাশোনা করছেন।

পাশের বাড়ির মো. শামসুর রহমান তারা মাস্টার বলেন, ‘শুধু জিয়াউর রহমানই নন, তার পূর্বপুরুষরাও এমনই ছিলেন। এরা উদারপন্থি ও পরোপকারী লোক হওয়ায় নিজের বাড়ির খোঁজখবর রাখেননি কখনো।’

বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘কতটুকু সৎ থাকলে সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির বাড়ি এমন থাকে বলুন! শুধু তাই নয়, তিনি বাংলাদেশের একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতাও। আর এই জিয়াউর রহমান ইচ্ছা করলে বাড়ি-গাড়ি কত কিছুই করতে পারতেন। কিন্তু উনি তা করেননি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান তথা উপমহাদেশের কোথাও কোনো এমন রাজনৈতিক পরিবার নেই। যাদের এমন বাড়িঘর।’

বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির উপদেষ্টা মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ শোকরানা বলেন, ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এতটাই সৎ ছিলেন যে তিনি তার নিজের বাড়ির অবকাঠামো উন্নয়ন করেননি। তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি ছিলেন। যে কারণে তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি কয়েকবার ক্ষমতায় আসে।’

 


Comments