একদিকে পদ শূন্য। অন্যদিকে যোগ্য প্রার্থীরা চাকরি পাচ্ছে না। এই বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সরকারের চাকরিসংক্রান্ত নীতির কারণে। সরকার নিয়ম করেছে মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রার্থী না পাওয়া গেলে সেই পদ শূন্য থাকবে। এ কারণে প্রতিটি বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পদ খালি থাকছে।
সরকারের তিন লাখের বেশি শূন্য পদের বেশির ভাগই নন-ক্যাডার হলেও ক্যাডার পদও রয়েছে। এসব পদ শূন্য থাকায় সরকার বিভিন্ন খাতের রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের তদারকিও ব্যাহত হয়। পদ শূন্য থাকলে বেকারদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়।
এই অবস্থায় পাবলিক সার্ভিস কমিশন ৩৬তম বিসিএসের ৩৬৬টি ক্যাডার পদ ৩৭তম বিসিএসের মেধাতালিকা থেকে এবং ৩৭তম বিসিএসের বিভিন্ন কোটার পদ খালি থাকলে তা মেধাতালিকা থেকে পূরণের সুপারিশ করেছে।
একই সঙ্গে ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষায় নন-ক্যাডার পদের জন্য অপেক্ষমাণ তিন হাজার ৩০৮ জন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা এককালীন শিথিল করার সুপারিশ করেছে সাংবিধানিক এ সংস্থাটি।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কারিগরি পদগুলোতে কোটা পদ্ধতির কারণে উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না এ কারণে অনেক পদ খালি থাকবে। আমরা কোটার প্রার্থী না পাওয়া গেলে এককালীন মেধাতালিকা থেকে তা পূরণের সুপারিশ করেছি।’
গত ১৭ অক্টোবর ৩৬তম বিসিএসের ফল প্রকাশ করে পিএসসি। দুই হাজার ৩২৩ জনকে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করার পরও ৩৬৬টি পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে কৃষি ক্যাডারের ১৬৮টি পদ শূন্য রয়েছে।
কৃষি ক্যাডারের পদগুলোর মধ্যে ১৪৬টি মুক্তিযোদ্ধা কোটার, চারটি মহিলা কোটার ও ১৮টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটার পদ। একইভাবে গণপূর্ত ক্যাডারের মুক্তিযোদ্ধা কোটার চারটি পদ শূন্য রয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণের জন্য সরকারি কলেজগুলোতে প্রভাষকের (বাংলা) ১৬টি পদ শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া দর্শনের ২৩টি, ইতিহাসের ৯টি, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ৩৪টি, উদ্ভিদবিদ্যার আটটি, কৃষিবিজ্ঞানের চারটি, হিসাববিজ্ঞানের ১২টি, সংস্কৃতের একটি এবং গণিতের ২৫টি পদ খালি রয়েছে।
মহিলা কোটার কারণে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রভাষকের ১১টি পদ, কৃষিবিজ্ঞানের একটি এবং গণিতের আটটি পদ খালি রয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটার কারণে ১১টি প্রভাষকের পদ খালি রয়েছে।
৩৭তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। এখন মৌখিক পরীক্ষা চলছে। ৩৭তম বিসিএসের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছিল এক হাজার ২২৬টি শূন্য পদ পূরণের জন্য। এর সঙ্গে ৩৬তম বিসিএসের শূন্য ৩৬৬টি পদ যোগ করে মোট এক হাজার ৫৯২টি পদ ৩৭তম বিসিএস থেকে পূরণের সুপারিশ করেছে পিএসসি।
৩৭তম বিসিএসের চিকিৎসা, কৃষি, প্রকৌশল, মৎস্য, পশুপালন ও শিক্ষকদের কারিগরি ও পেশাগত ক্যাডারের শূন্য পদ ৭৬১টি। যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে পদ সংরক্ষণের সরকারি সিদ্ধান্তের বাধ্যবাধকতার কারণে বিগত অন্যান্য বিসিএসের মতো ৩৭তম বিসিএসের কারিগরি ও পেশাগত ক্যাডারের মুক্তিযোদ্ধা কোটার ২২৮টি, মহিলা কোটার ৭৬টি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটার ৩৮টি পদের বেশির ভাগই শূন্য থাকার আশঙ্কার কথা সরকারকে জানিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন। এ কারণে এসব পদ সংরক্ষিত না রেখে মেধাবীদের মাধ্যমে পূরণ করার সুপারিশ করেছে পিএসসি।
সাধারণ ক্যাডারগুলোর ক্ষেত্রে শূন্য পদের চেয়ে কৃতকার্য প্রার্থী বেশি থাকায় সাধারণ ক্যাডারের মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় কোনো পদ খালি থাকে না। কিন্তু কারিগরি ও পেশাগত ক্যাডারের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় প্রাপ্য পদের চেয়ে কৃতকার্য প্রার্থীসংখ্যা কম থাকায় এসব কোটার সব পদ পূরণ করা সম্ভব হয় না। কিছু ক্ষেত্রে প্রার্থী কম থাকায় মেধা কোটার সব পদও পূরণ করা সম্ভব হয় না।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব আলী ইমাম মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটি বিসিএসের এক-তৃতীয়াংশ পদ যদি শূন্য থাকে তাহলে পিএসসির প্রতিবছর জনবল নিয়োগের যে উদ্দেশ্য তা ব্যাহত হয়। দেশের শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীকে চাকরি দেওয়ার জন্য প্রতিবছর বিসিএস আয়োজন করে পিএসসি। একটা বিসিএস শেষ হতে কয়েক বছর সময় লাগে। এর সঙ্গে পিএসসির বিশাল কর্মযজ্ঞ জড়িত।
প্রতি বিসিএসে লাখ লাখ পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। তাদের মধ্য থেকে দুই-তিন হাজার প্রার্থী খুঁজে বের করতে হয়। এই জটিল কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে শেষ করার পরও তাদের নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করতে পারছে না পিএসসি। এটা সম্ভব হয় না কোটা পদ্ধতির কারণে। দ্রুত এ কোটা পদ্ধতির সংস্কার দরকার।’
পিএসসির একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় ২৮তম বিসিএসে নন-ক্যাডার প্রথম শ্রেণির ৯১টি, ২৯তম বিসিএসে ৪৫টি, ৩০তম বিসিএসে ৮৫টি, ৩১তম বিসিএসে ৩৬টি, ৩২তম বিশেষ বিসিএসে ১৩টি, ৩৩তম বিসিএসে ৯১টি এবং ৩৪তম বিসিএসে ৬২টি প্রথম শ্রেণির পদ খালি রয়েছে।
একইভাবে ৩৩তম বিসিএসে ৮৫টি, ৩৪তম বিসিএসে এক হাজার ২৪৬টি দ্বিতীয় শ্রেণির পদ খালি রয়েছে। ৩৫তম বিসিএসে নন-ক্যাডার পদের জন্য অপেক্ষমাণ ছিল তিন হাজার ৩৫৯ জন। মুক্তিযোদ্ধা কোটার জন্য পদ সংরক্ষণের শর্ত শিথিল করায় ওই বিসিএসের নন-ক্যাডারের সব পদ পূরণ করা সম্ভব হয়েছে।
৩৬তম বিসিএস পরীক্ষায় নন-ক্যাডার পদের জন্য অপেক্ষমাণ প্রার্থীর সংখ্যা তিন হাজার ৩০৮ জন। তাদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটার শূন্য পদ সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে পিএসসি।
জনপ্রশাসন সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পিএসসির এসব সুপারিশ নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কাজ করছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। কারণ মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভায় নেওয়া।’
বাংলাদেশ ছাত্রপরিষদের সভাপতি আল আমিন রাজু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোটা পদ্ধতি মূল্যায়নের সময় এসেছে। এই যে বছরের পর বছর কোটা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে তা উদ্দেশ্য পূরণে কতটা সহায়ক হয়েছে তা মূল্যায়ন করা দরকার। কারণ অনগ্রসরদের সুবিধা দেওয়ার জন্য কোটা চালু হয়েছে।
এখন এই কোটা সুবিধা নিয়ে নারীরা কতদূর এগিয়েছে তা মূল্যায়নের দাবি রাখে। একইভাবে অন্য কোটার সুবিধা নিয়ে কারা কতটুকু এগিয়েছে তাও দেখতে হবে।’