বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার দায়িত্ব উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহী পদ এইগুলি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সার্বিক তত্ত্বাবধান করিয়া থাকেন ভিসি, প্রো-ভিসি ও কোষাধ্যক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, একাডেমিক কমিটি, অর্থ কমিটি ও শৃঙ্খলা কমিটির মতো গুরুত্বপূর্ণ সকল কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করিতে হয় ভিসি বা উপাচার্যকে। তাহার মাধ্যমেই এসকল কমিটির সদস্য মনোনয়ন, ডিন এবং বিভাগীয় প্রধান নিয়োগ দানের বিধান রহিয়াছে।
অথচ এই পদগুলিই খালি রাখিয়া কার্যক্রম চালাইতেছে ১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে দেশে সরকার অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯৬টি, ইহার মধ্যে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় এখনো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেনি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) হালনাগাদ তালিকা অনুযায়ী, ১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতি নিয়োগকৃত কোনো উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নাই।
অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পর্যায়ে শতাধিক পদ খালি পড়িয়া আছে। উপাচার্য ছাড়াই চলিতেছে দেশের ২৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আইনে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার কথা বলা হইয়াছে।
ফলে প্রশ্ন উঠিতেই পারে, এই গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীদের অনুপস্থিতিতে কীভাবে চলিতেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি!
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হইলেন উপাচার্য। অথচ ২৯টি বিশ্ববিদ্যালয়েই রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত উপাচার্য নাই। অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ খালি রাখিবার পাশাপাশি, বত্সরের পর বত্সর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য দিয়াই প্রশাসন চালাইতেছে অনেক বেসরকারি বিশ্বদ্যািলয়।
ভারপ্রাপ্ত নিয়োগপ্রাপ্তরা গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় অনুমোদন দান করিতে পারেন না। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হইতেছে। প্রতিষ্ঠানগুলি স্বৈরতান্ত্রিক হইয়া উঠিতেছে। গুরুত্বপূর্ণ এসকল পদ খালি থাকায় নিয়মিত সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল ও অর্থ কমিটির মতো বাধ্যতামূলক সভা পরিচালনা করাও সম্ভব হইতেছে না।
ইউজিসির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ কমিটির কোনো সভা হয়নি। একাডেমিক কাউন্সিলের সভা হয়নি ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর সিন্ডিকেট সভা করেনি ১৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চশিক্ষা শেষে শিক্ষার্থীদের সনদে স্বাক্ষর করিবার অধিকারী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত উপাচার্য। কিন্তু উপাচার্য না থাকায় অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তীর্ণরা মূল সনদ উত্তোলন করিতে গিয়া বিপাকে পড়িতেছেন।
আইনগত বৈধতা না থাকা সত্ত্বেও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃক নিয়োগকৃত অস্থায়ী উপাচার্য মূল সনদে স্বাক্ষর করিতেছেন— যাহা বস্তুত অবৈধ একটি কাজ।
উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্র, বিশেষত, কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেন এক স্বেচ্ছাচারিতার কেন্দ্র হইয়া উঠিয়াছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব খাটাইয়া অনেকেই প্রচলিত আইনগুলিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাইতেছে। আর্থিক অনিয়ম, অর্থ বাঁচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দানে বিরত থাকা, স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে যেনতেন উপায়ে শিক্ষাক্রম চালাইয়া নেওয়ার ঘটনা নৈমিত্তিক হইয়া উঠিয়াছে।
ইউজিসির পক্ষ হইতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বিভিন্ন সময়ে এই বিষয়ে লিখিতভাবে তাগিদ দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ফলে, এই সকল অনাচারে কেবল শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে না, উচ্চশিক্ষার সংস্কৃতিটাই মুনাফার লোভ ও ক্ষমতার দাপটের তলায় লোপাট হইয়া যাইতেছে।
শিক্ষাক্ষেত্রের এই দৈন্যদশা বিকাশমান একটি দেশের জন্য কিছুতেই কাম্য হইতে পারে না।