বগুড়ার মহাস্থানগড়ের হজরত শাহ সুলতান বলখী (রহ.) মাজার মসজিদের হিসাব (অ্যাকাউন্ট) থেকে প্রায় ৮৫ লাখ টাকা খেয়ে ফেলেছেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের মহাস্থানগড় শাখার ব্যবস্থাপক মো. জোবাইনুর রহমান। তাঁকে সহযোগিতা করেছেন একই শাখার সিনিয়র অফিসার মো. কায়েদে আযম।
এ ছাড়া এই দুই ব্যাংকার ওই শাখায় থাকা স্থানীয় সংসদ সদস্য শরিফুল ইসলাম জিন্নাহর বাবার দুটি হিসাবেরও ৫৩ লাখ টাকা তুলে খেয়ে ফেলেছেন।
আরো অনেক গ্রাহকের সঞ্চয়ী হিসাবের টাকা এবং বিভিন্ন গ্রাহকের নামে ভুয়া ঋণ দেখিয়ে মোট প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়েছেন তাঁরা। এসব ঘটনায় ওই দুই ব্যাংকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
অভিযুক্ত শাখা ব্যবস্থাপক জোবাইনুর রহমান বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার আগুনিয়া তাইর গ্রামের মনতেজার রহমানের ছেলে। তবে তিনি বগুড়া শহরের নামাজঘর এলাকার একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। তাঁর ওই বাসাটি এখন তালাবদ্ধ। অভিযুক্ত আরেক ব্যাংকার মো. কায়েদে আযমের বিস্তারিত ঠিকানা পাওয়া যায়নি।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মাজার মসজিদের টাকা আত্মসাতের ঘটনা তদন্ত করে প্রমাণও পেয়েছে বগুড়া জেলা প্রশাসন। এরপর ওই দুই ব্যাংকারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনারকে চিঠি পাঠিয়েছেন বগুড়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক নূরে আলম সিদ্দিকী গত সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাজার মসজিদের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮৪ লাখ ৬০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। একজন সংসদ সদস্যের বাবার দুই হিসাব থেকেও ওই ম্যানেজার অর্থ তুলে আত্মসাৎ করেছেন বলে শুনেছি।
আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে তছরুপ করা অর্থ সমন্বয় ও দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছি। এরই মধ্যে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ একটি মামলা করেছে। অভিযুক্ত ম্যানেজার ও অন্যরা পলাতক।’
অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো বগুড়া জেলা প্রশাসকের চিঠিতে বলা হয়েছে, মাজারে আসা ভক্তরা মাজারসংলগ্ন মসজিদে অর্থ দান করেন। ব্যাংকটির মহাস্থানগড় শাখায় ‘মহাস্থান মাজার মসজিদ কমিটি’ চলতি হিসাব নম্বর (৪০৮৫০২০০০০৬২০) পরিচালনা করে আসছে।
মসজিদ কমিটি প্রতি মাসে একবার করে হিসাব বিবরণী সংগ্রহ করে। গত ২ ফেব্রুয়ারি মাসিক হিসাব বিবরণী সংগ্রহের পর দেখা যায়, মাজার কমিটির কাছে সংরক্ষিত ক্যাশ বইয়ের তুলনায় হিসাবে ৮৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা কম রয়েছে।
মাজার মসজিদ কমিটি বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে জানালে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, মসজিদ কমিটির হিসাব থেকে ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক মো. জোবাইনুর রহমান ও তাঁর সহকর্মী মো. কায়েদে আযম যোগসাজশ করে ৮৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা তছরুপ করেছেন।
বগুড়া-২ আসনের সংসদ সদস্য শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকটির ওই শাখায় তাঁর বাবা আলহাজ আজিম উদ্দিন প্রামাণিকের একটি এফডিআর হিসাবে ২০ লাখ টাকা ছিল, যা সুদাসলে প্রায় ৩৭ লাখে দাঁড়ায়।
আরেকটি সঞ্চয়ী হিসাবে ছিল ১৬ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। দুই হিসাবের পুরো টাকাই ম্যানেজার তুলে নিয়ে পালিয়েছেন।
জিন্নাহ বলেন, ‘দুই মাস আগে আমার বাবা মারা যান। তারপর আমি ব্যাংকে গিয়ে স্টেটমেন্ট তুলে আনি। তখনও সব কিছু ঠিকঠাক ছিল। এর তিন দিনের মাথায় শুনি মাজার মসজিদের ৮৫ লাখ টাকা ম্যানেজার আত্মসাৎ করেছেন।
তখনই ব্যাংকে গিয়ে আবার বাবার অ্যাকাউন্ট দুটির স্টেটমেন্ট চাই। তখন দেখা যায়, কোনো হিসাবেই কোনো টাকা নেই। পুরোটাই ম্যানেজার তুলে নিয়েছেন।’
এ ঘটনায় কোনো মামলা করেছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনো মামলা করিনি। মামলা করলে দীর্ঘ সময় লাগবে। এখন ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে অর্থ কিভাবে ফেরত পেতে পারি, সে চেষ্টা করছি।’
স্থানীয়রা জানায়, ম্যানেজার শুধু ওই তিন হিসাব থেকেই নয়, তাদের অনেক হিসাব থেকেও টাকা তুলে পালিয়েছেন। এলাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কৌশলে চেক নিয়ে তাদের হিসাব থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন ম্যানেজার।
এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ভুয়া ঋণ দেখিয়ে সেই টাকাও তুলে নিয়ে পালিয়েছেন ম্যানেজার। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন ম্যানেজার ও তাঁর সহযোগী।