ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল নিবিড় পল্লী হতে উঠে আসা এক মাদ্রাসা ছাত্রী খাদিজা খাতুন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। যোগ দিয়েছেন প্রভাষক, ফলিত গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি তার অভিব্যক্তি তুলে ধরেছেন -
আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সবসময় বলি, তোমরা চেষ্টা কর, অবশ্যই সফল হবে। তোমরা যে কাজটা করতে চাচ্ছ, নিজের সবটুকু দিয়ে সে কাজটা করবে। পরিবারের ভিতরে সমস্যা হতেই পারে। তোমরা সবসময় সবকিছু শিক্ষকদের সাথে শেয়ার করবে।
শিক্ষকরা তোমাদের বন্ধুর মত। আমরা তাদেরকে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করি। আমি নিজে শিক্ষকদের অনেক সহযোগিতা পেয়েছিলাম।
ছাত্রছাত্রীদের ভিতরে যদি কারো কোন সমস্যা থাকে, সেটা হোক ব্যক্তিগত বা পারিবারিক, আমি তাদেরকে নিজের পক্ষে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করি। অন্য স্যারদের সাথে কথা বলে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করি। সেজন্য আমি ওদেরকে বলি, যদি কখনও কোন সমস্যা হয়, চিন্তা না করে সরাসরি বলবে।
১ সেকেন্ড চিন্তা করা মানে ১ সেকেন্ড সময় নষ্ট করা। সমস্যার জন্য বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলে হয়। তবে শিক্ষকদের সাথে শেয়ার করলে সমাধানটা খুব ভাল আসে।
ময়মনসিংহের অজপাড়াগাঁওয়ের মাদ্রাসা ছাত্রীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ায় এলাকায় আনন্দের বন্যা
নিবিড় পল্লী হতে তাঁর উঠে আসার গল্প তুলে আনতে প্রায় ২ঘন্টা কথোপকথন হয় বাবা-মা সহ ছোট বোনের সাথে।
ফুলবাড়ীয়া উপজেলা সদর হতে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রায় ৩০কিলোমিটার অদূরে এনায়েতপুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের এনায়েতপুর গ্রামের মহিষেরচালা (মইষের)। এনায়েতপুর বাজার ভায়া রাজঘাট কাঁচা রাস্তা ঘেঁষে খাদিজার বাড়ী।
সাধারণ একটি নিরীহ বাড়ীর মতই এটি। বাড়ীতে টিনসেট ৩টি ঘর। নিরিবিলি পরিবেশ আন্দাজ করতে পেরে দূর থেকে আমরা খেয়াল করলাম বাড়ী থেকে একজন পুরুষ লোক বের হচ্ছে; সহকর্মী এনায়েতুর রহমানের মোটর বাইক থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- খাদিজার বাড়ী কোনটি। তিনি আমাদের পরিচয় জেনে বললেন- খাদিজা আমার নাতনী।
তাঁর বাবা বাড়ীতে আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি (খাদিজার বাবা) জানাজা নামাযে গিয়েছেন বলে আমাদের জানালেন। ছবি তোলার কাজটি শেষ করে বাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করার ৫মিেিনটর মাথায় একজন ভদ্র লোক বাই সাইকেল চালিয়ে বাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করলেন। আমরা ও তাঁর পরিচয় জানা হল। আমরা জানতে চাইলাম খাদিজার উঠে আসার গল্প।
খাদিজা খাতুনের বাবা মো: রুহুল আমিন, মাতা হালিমা খাতুন, তাঁর ৪ছেলে, ২মেয়েসহ ৮জনের সংসার। ভাই-বোনদের মধ্যে খাদিজা দ্বিতীয়। বড় ছেলে সোহাগ কৃষক, তৃতীয় সন্তান তাসলিমা- ইডেন কলেজের ছাত্রী, চতুর্থ সন্তান আনোয়ার হোসেন মুঞ্জু- এম এম আলী কলেজের অনার্সের ছাত্র, পঞ্চম সন্তান আজহারুল ইসলাম (শারীরিক প্রতিবন্ধি)- চলতি দাখিল পরীক্ষার্থী, তারিকুল ইসলাম- পঞ্চম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত।
খাদিজা খাতুনের নানার বাড়ী রাজঘাট এলাকায়। সেই বাড়ীর কাছে এনায়েতপুর ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসা (রাজঘাট মাদ্রাসা)। ঐ সময় সেই মাদ্রাসায় ৪র্থ শ্রেণিতে লেখাপড়া করতো খাদিজার মামা মোশাররফ। সেই সুবাধে খাদিজার লেখাপড়া শুরু মাদ্রাসা থেকে।
৮বছর লেখাপড়া শেষে ৮ম শ্রেণীতে উদ্দীপনা পুরস্কার পেয়ে পরীক্ষায় উপজেলায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে।
মেধাবী ছাত্রীর অভিভাবক হিসেবে পরিচালনা কমিটিতে স্থান হয় খাদিজার বাবা মো: রুহুল আমিনের। দাখিল পরীক্ষায় গোল্ডেন ‘এ’ প্লাস অর্জন করেন খাদিজা। ঐ মাদ্রাসায় আলিমে বিজ্ঞান শাখা না থাকায় তাঁর মেয়েকে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ ময়মনসিংহে ভর্তি করানোর জন্য চেষ্টা করেন।
কিন্তু মাদ্রাসা ছাত্রী হওয়ায় তাঁকে (খাদিজা) ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত খাদিজা ফুলবাড়ীয়া উপজেলার আছিম শাহাবুদ্দিন (ডিগ্রী) কলেজে ভর্তি হোন।
এ কলেজে খাদিজার মেধার প্রখরতা দেখে শিক্ষকরা তাঁকে ফ্রি প্রাইভেট পড়ানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সেখানে খাদিজা সহপাঠীদের মাধ্যমে বাঁধাগ্রস্থ হন। বিষয়টি স্থানীয় বাসিন্দা ও ফুলবাড়ীয়া পৌরসভা অফিসে কর্মরত হাবিবুর রহমান শাহীনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অধ্যক্ষের হস্তক্ষেপে স্বাভাবিক হয়।
আমি (রুহুল আমিন) যখন খাদিজা কে নিয়ে ফুলবাড়ীয়া কলেজে ব্যবহারিক পরীক্ষা দেয়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম পরীক্ষকবৃন্দ মৌখিক পরীক্ষায় দীর্ঘ সময় প্রশ্ন করতে থাকেন। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে প্রায় আধ ঘন্টা সময় অতিবাহিত করলেও খাদিজা বের হচ্ছে না, তখন আছিম শাহাবুদ্দিন কলেজের সাদেক স্যার বের হয়ে আমাকে বললেন, ‘যে কোকিলের ডাক সুন্দর, সেই কোকিলের ডাক সবাই শুনতে চায়’ তখন আছিমের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ফুলবাড়ীয়া কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ (অব.) মো: আব্দুল হাকিম স্যার আমাকে রুমের ভেতর ডেকে নিয়ে বলেন, আমাকে ওয়াদা দিতে হবে তোমার মেয়েকে ঢাকায় কোন কোচিং সেন্টারে ভর্তি করাতে হবে।
আমি স্যারকে কথা দিয়েছিলাম। অবশেষে ঢাকা মৌচাক এলাকায় কোচিং সেন্টারে ভর্তির একটি সাইনবোর্ড দেখতে পেয়ে ভেতরে পরিচালকের সাথে কথা হল।
আমি উনাকে সাধ্যের (অপারগতা) বিষয়টি অবগত করালে, তিনি আমাকে খাদিজার কাগজপত্র দেখানোর কথা বললে, তিনি (পরিচালক) আমাকে বললেন আপনার মেয়েকে ৫হাজার টাকায় ভর্তি করাবো, তবে আপনার মেয়েকে এ কথাটি বলতে পারবেন না। আমি ১হাজার টাকা দিয়ে বাকী টাকা পরে দিব বলে ভর্তি করিয়ে দিলাম। মৌচাক এলাকায় তাঁর (খাদিজা) কাকা হাবিবুর রহমান থাকায় সেখানে থেকে কোচিং চলছিল।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হলেও চয়েস অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় খাদিজা। গণিতে ভর্তি হয়ে শামসুন্নহার হলে থাকতে শুরু করেন খাদিজা।
লেবু বাগান ও কৃষি কাজ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বছর দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা প্রতি মাসে দিতেন বাবা রুহুল আমিন। দ্বিতীয় বছর হতে ব্যাচের সেরা ছাত্রী হিসেবে টিউশনির চাহিদাও বেড়ে যায় খাদিজার। ফলে আর তাকে প্রতি মাসে টাকা দিতে হয়নি। বাবার আশা ছিল আদর্শ শিক্ষক বানানো।
মাস্টার্স শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিলে উর্ত্তীণ হন খাদিজা। প্রতিদিন খাদিজার সাথে কথা হয় বাবা মা’র। যেদিন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে যান খাদিজা সে দিন পরীক্ষার হলে প্রবেশের পূর্বে বাবা-মায়ের দোয়া (আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলেন বাবা) নিয়েছিলেন।
সোনার হরিণ প্রাচ্যের অক্সফোর্ট খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদে ২ফেব্রুয়ারি/২০১৭ ফলিত গণিত বিভাগে যোগদান করেন খাদিজা। চোখের পানি মুছতে মুছতে বাবা রুহুল আমিন বলেন আমার আশা পূরণ হয়েছে।
প্রথমে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে বাবা রুহুল আমিন শিক্ষক, এলাকাবাসীসহ সকলের কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। নাম দস্তখত জানা রুহুল আমিন জানান, তিনি নিয়ত করেছিলেন যদি মেয়ের একটু হেল্প পান তাহলে বাকী সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে কোন সময় পিছপা হবেন না তিনি। অবশেষে তার আশা পূরণ হওয়ায় তিনি মহাখুশি।
খাদিজা খাতুন বলেন, অজোপাড়া গায়ের সন্তান আমি। অবহেলিত ও অশিক্ষিত সেই সমাজের মানুষের জন্য কাজ করতে চাই এবং মানুষের পার্শ্বে দাঁড়াতে চাই। প্রত্যাশিত আশা পূরণ হয়েছে তবে আমি অনেক দূর অগ্রসর হতে চাই।