মোহাম্মদ তালহা তারীফ
‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে’ আজ যারা বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা একদিন শিশু ছিল, শিশু থেকেই তারা আজ যুবক হয়েছে। শিশুরা আল্লাহতায়ালার বড় এক নিয়ামত। পিতা-মাতার জন্য আমানত।
শিশুর মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন, ‘শিশুরা হল জান্নাতের প্রজাপতি’। (মিশকাত শরিফ)
শিশুদের সময়মতো নামাজ শিক্ষা দেয়ার প্রতি অভিভাবকদের তাগিদ দেয়া হয়েছে।
আবু দাউদ শরিফে রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের সন্তানরা যখন সাত বছরে পড়ে তখন তাদের নামাজ পড়ার নির্দেশ দাও, আর দশ বছর বয়স হলে তাদের নামাজের জন্য শাসন কর ও তাদের বিছানা পৃথক করে দাও’ তাই রাসূল (সা.) ছোটদের নামাজের জন্য মসজিদে নিয়ে যেতেন।
আমাদের সন্তানদের হাত ধরে আমরা যদি মসজিদে নিয়ে না আসি তাহলে কে তাদের মসজিদে আনবে, কে শিক্ষা দেবে তাদের নৈতিকতা শিষ্টাচার আর নামাজের নিয়মনীতি। তাদের মসজিদে নিয়ে যাওয়াটাকে আমরা দূষণীয় মনে করি।
অথচ বাংলা নববর্ষের দিন, বাণিজ্য মেলা, বইমেলাসহ জাতীয় দিবসে কিংবা অনুষ্ঠানে শিশুদের কাঁধে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে তাদের নিয়ে দেখানো হয় সেটি দূষণীয় মনে করি না।
শিশুদের মসজিদে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিয়ে আসা হচ্ছে না এর কারণ হল, তারা দুষ্টামি করে, এটাই ধরা হয় তাদের একমাত্র দোষ। শিশুরা তো দুষ্টামি করবেই এটাই স্বাভাবিক।
শিশুরা মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে অজু করার সময় পানির টেপ নিয়ে দুষ্টামি করে, অপরকে পানি ছিটানো, মসজিদে লুকোচুরি খেলা, শূন্য হাতে বিভিন্ন রকমের খেলার অঙ্গভঙ্গি করা, টুপি নিয়ে কাড়াকাড়ি, সবাই সিজদায় যায় আর তারা দাঁড়িয়ে থাকে, কিংবা সিজদায় না গিয়ে একে অপরকে পিঠে কিল-ঘুষি দিয়ে সিজদায় যায় আবার সিজদায় গিয়ে কিল খেয়ে সে অন্যকে চড় দিলে শুরু হয় চেঁচামেচি।
কান্নাকাটি করাসহ কত রকমের দুষ্টামি করে তারা। এই দুষ্টামির কারণ রয়েছে, একই বয়সের শিশু পাওয়ায় এরকম দুষ্টামি করা শিশুদের স্বভাব। শিশু অবস্থায় প্রায় এই দুষ্টামি করে থাকে।
তাই বলে কি তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা উচিত। বিভিন্ন মসজিদে দেখা যায় শিশুরা মসজিদে এলো। স্থানীয় মসজিদের হাজি সাহেব কিংবা মসজিদের মুরব্বি শিশুদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে মসজিদে যাওয়া শিশুদের বলে ওঠে পোলাপান খবরদার শয়তানি করবি না।
সামনে বসা শিশুদের পেছনে বসার জন্য ধমকের সঙ্গে বলে পোলাপান বেয়াদব হয়ে গেছে। মুরব্বির কথায় সমর্থন দেয় আরও কয়েকজন মুসল্লি। আর বলে দেয় খবরদার আর যেন মসজিদে না দেখি।
যদি মসজিদে দেখি তাহলে মাইরা হাড্ডি ভাইঙ্গা দিমু। নানা অনুষ্ঠানে শিশুদের সঙ্গে বড়দের খাবারের পার্থক্য থাকে। বড়দের যদি দেয়া হয় দুই প্যাকেট তাহলে তাদের দেয়া হয় এক প্যাকেট।
দুটি মিষ্টি বড়দের দিলে ছোটদের দেয়া হয় একটি। এভাবে ছোট থেকেই তাদের মনে কষ্ট দেয়া হয়। ছোট হয়ে যায় তাদের মনমানসিকতা। এমন ব্যবহারের কারণে একটি শিশু মসজিদ বিমুখ হয়ে নামাজ পড়া বন্ধ করে দিতে পারে।
শিশুটি যদি দুষ্টামি করেই ফেলে তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা জরুরি। শিশুদের প্রতি মুরব্বিদের ব্যবহার দেখলে মনে হয় যেন মসজিদে কোনো নিকৃষ্ট প্রাণী প্রবেশ করেছে। অথচ ইসলাম শিশুদের দিয়েছে মর্যাদা আর সম্মান। কোনো অবস্থাতেই তাদের অবহেলা করা উচিত নয়, দয়া-মায়া দেখাতে হবে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে আমাদের শিশুদের প্রতি দয়া øেহ করে না সে আমাদের মধ্যে গণ্য নয়’। (বুখারি শরিফ)
শিশুদের রাসূল (সা.) মসজিদে নিয়ে যেতেন। এমনকি রাসূল (সা.) নামাজে দাঁড়ালে যদি কোনো শিশু তাকে বিরক্ত করত তাদের তিনি ধমক দেননি বরং তাদের মসজিদে নিয়ে আসতেন।
বুখারি শরিফে উল্লেখ রয়েছে, রাসূল (সা.) তার নাতনী হজরত উমামা বিনতে যায়নাব (রা.) কে কাঁধে করে মসজিদে নিয়ে আসতেন। যখন রাসূল (সা.) সিজদায় যেতেন তখন উমামা (রা.) রাসূল (সা.)-এর পিঠে উঠে যেতেন। কিন্তু তিনি কখনও তাকে ধমক দেননি। শুধু তাই নয়, রাসূল (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় নাতি হজরত হাসান হুসাইন যখন রাসূল (সা.) নামাজের সিজদাবস্থায় থাকতেন তখন তারা পিঠে কিংবা ঘাড়ে উঠে যেতেন।
রাসূল (সা.) বুঝতে পারতেন যে তারা খেলা করছে। তাই তিনি সিজদায় অনেক সময় ব্যয় করতেন। কত সুন্দর ব্যবহার বিশ্বনবী শিশুদের সঙ্গে করেছেন। এখানেই শেষ নয়, রাসূল (সা.)-এর খুতবা দেয়ার সময় তার নাতি হাসান ও হুসাইন এলে তিনি খুতবা দেয়া বন্ধ রেখে তাদের জড়িয়ে ধরে আদর করতেন, কোলে তুলে নিতেন, চুম্বন করতেন আর বলতেন, খুতবা শেষ করা পর্যন্ত আমি ধৈর্য ধরতে পারব না, তাই আমি খুতবা বন্ধ রেখে এদের কাছে চলে এসেছি। রাসূল (সা.) এভাবেই শিক্ষা দিয়েছেন তার উম্মতদের। তারা যেন শিশুদের ভালোবাসে, তাদের কষ্ট না দেয়।
শিশুদের সঙ্গে যদি আমরা এমন সুন্দর ব্যবহার করি তাহলে তারা খুশি হবে। বড়দের থেকে ছোটরাই শিখবে। শৈশব থেকে শিশুদের ভালো আচরণ শিক্ষা দিয়ে উত্তম মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
শিশুদের শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া সম্পদ দান করার চেয়ে উত্তম। রাসূল (সা.) বলেন, ‘সন্তানদের আদব তথা শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া সম্পদ দান করার চেয়ে উত্তম’। (বায়হাকী)
লেখক : শিক্ষার্থী, সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া