আমি থাকতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলে। আমার রুমটি দুই সিটের। আমার রুমমেট ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এবং আমার ইয়ারমেট। ঘটনাটি বেশ কয়েক বছর আগের। এক দিন আমার রুমমেটের বড় ভাই এলেন। তিনি গেস্ট হিসেবে থাকতে শুরু করলেন আমাদের সাথে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে অনার্স মাস্টার্স পাস করেছেন। বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। সামনে ভাইবা। ভাইবা উপলক্ষে ছোটভাইয়ের রুমে এসেছেন অতিথি হয়ে। এটি তার জীবনের শেষ বিসিএস ও ভাইবা। এর আগে তিনি কতবার বিসিএস দিয়েছেন তা ঠিক এখন আমার মনে নেই। তবে প্রতিবারই তিনি লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন এবং ভাইবা থেকে তাকে ফেরত দেয়া হয়েছে। ভদ্রলোক বেশ সহজ সরল প্রকৃতির ছিল। মাস্টার্স পাস করে হল ছেড়ে বেশ কয়েক বছর মেসে ছিলেন বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার জন্য। কিন্তু পরে গ্রামে চলে যান।
তার জীবনের একমাত্র স্বপ্ন বিসিএস ক্যাডার হওয়া। সেজন্য তিনি আর কোনো চাকরিতে যোগ দেননি। তেমন চেষ্টাও করেননি। দীর্ঘ দিন রুমে থাকার সময় তার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা শুরু হলে তিনি ঘুরে ফিরে বলতেন বিসিএস নিয়ে তার স্বপ্নের কথা। প্রশাসন ক্যাডার ছিল তার পছন্দের।
চাকরি পেলে তিনি কী করবেন সে চিন্তা ও পরিকল্পনার কথা বলতেন বারবার। বিসিএস চাকরি নিয়ে স্বপ্নের কথা বর্ণনার সময় তার চোখ দু’টি ছলছল করে উঠত। কল্পিত জীবনের আনন্দে আত্মহারা হওয়ার একটি আভাস ফুটে উঠত তার চেহারায়।
এর আগে বিসিএসের যেসব ভাইবায় তিনি মুখোমুখি হয়েছেন সে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতেন। আর সামনে কিভাবে ভাইবার মুখোমুখি হবেন সে বিষয়ে পরিকল্পনার কথাও বলতেন। আমার কাছেও মাঝে মধ্যে পরামর্শ চাইতেন।
এভাবে এক দিন তার ভাইবার দিন ঘনিয়ে এলো। ভাইবার জন্য হালকা নিল রঙের একটি জামা তার আলাদা করে রাখা ছিল। তার ওপর টাই পরলেন। ভাইবা দিলেন। খুবই ভালো ভাইবা দিলেন। এর আগেও যেমন প্রতিবার ভাইবা দিয়েছিলেন। তিনি আশাবাদী এবার যেহেতু শেষ বিসিএস তাই অন্তত তাকে আর ফেরত দেবে না বোর্ডের লোকজন।
এক দিন রেজাল্ট প্রকাশিত হলো। আমার রুমমেটের বড় ভাই পেপার রুমে গেলেন। তার যাওয়ার একটু পরে আমিও গেলাম সেখানে। আমি দেখলাম তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে তার রোল নম্বর খুঁজছেন খবরের কাগজের পাতায়। জীবনে এত মনোযোগ দিয়ে কাউকে কোনো কিছু খুঁজতে দেখিনি।
আমিও ভাবছি হয়তো এক্ষুনি তিনি তার রোল নম্বরটা দেখতে পাবেন আর পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দিত মানুষ আমি দেখতে পাবো। কিন্তু রোল নম্বর যতই শেষের দিকে ততই তার চেহারা ম্লান হতে থাকল। তার চেহারায় বিপদের গভীর ছাপ দেখে আমি বুঝতে পারলাম শেষ রোল নম্বরটি তিনি দেখে ফেলেছেন এবং তাতে তার নামের রোল নম্বরটি নেই। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যে, তার নাম নেই তালিকায়। এ সত্ত্বেও তিনি আবার শুরু থেকে রোল নম্বর দেখা শুরু করলেন।
তার বিশ্বাস তিনি হয়তো ভালো করে সব নম্বর পরীক্ষা করে দেখতে পারেননি। তার নামটি হয়তো এড়িয়ে গেছে দেখার সময়। তাই আবার দেখা শুরু করলেন। আমি তাকিয়েই রইলাম। আমার মনে হচ্ছিল জীবনে বিশেষ কিছু একটা দেখছি। না এবারো তিনি খুঁজে পেলেন না তার রোল নম্বর। কিছুটা সময় তিনি মাথা নিচু করে বসে রইলেন। কিন্তু এখানে শোক স্তব্ধ হওয়া বা কান্না বা অশ্রুপাতের সুযোগ নেই। পেপার রুমে সকালে অনেকে এসেছেন কাগজ পড়তে। তিনি ধীরে ধীরে উঠে চলে যেতে লাগলেন মাথা নিচু করে। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম ভারী একটি বোঝা তিনি বহন করছেন।
অতি ধীরে তিনি হাঁটতে লাগলেন। আমিও একটু পরেই রুমে ফিরে গেলাম। আমি রুমে ঢুকতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি। আমি চুপচাপই থাকলাম। কারণ এ রকম একজন মানুষকে কী বলে সান্ত্বনা দেয়া যায় তা আমার তখন জানা ছিল না।
বর্তমানে কোটা সংস্কারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে মর্মস্পর্শী এ ঘটনার স্মৃতি এ প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের কয়েক বছর আগের একজন বাসিন্দা।
তিনি বলেন, আমার বিশ্বাস আমার রুমমেটের এ বড় ভাই বিসিএস পরীক্ষায় চান্স পাওয়ার যোগ্য ছিল অবশ্যই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যারা বিসিএস দেয় তারা যে সবাই চান্স পায় তা নয়। কিন্তু নানা কারণে অনেক যোগ্য প্রার্থী চান্স পায় না এটিও আমরা আমাদের হল জীবনে চোখের সামনে দেখেছি বারবার।
আমার হল জীবনে যতবার বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়েছে ততবারই দেখেছি হলে আমাদের পরিচিত অনেক বড় ভাই চান্স পেয়েছেন। রেজাল্ট প্রকাশের পর তাদের নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা করতাম আমরা। আমরা দেখেছি তুলনামূলক কত অযোগ্য, অমেধাবীরা চান্স পেয়েছেন।
আবার কত অধিক মেধাবী বাদ পড়েছেন। ফল দেখতাম অনেক ক্ষেত্রেই উল্টো। যারা চান্স পেত তাদের অনেকের ছাত্র রাজনীতি, দলীয় পরিচয়, কোটাসহ বিভিন্ন ধরনের কানেকশনের কথা সবার মুখে মুখে আলোচিত হতো তখন।
জহুরুল হক হলের এ বাসিন্দা জানান, শেষ বিসিএসে চান্স না পাওয়ার পর আমার রুমমেটের ওই বড় ভাই আবার গ্রামে ফিরে গেলেন। পরে আমার রুমমেটের মাধ্যমে জানতে পেরেছি তিনি সামান্য বেতনে গ্রামে একটি বেসরকারি কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগ দিয়েছেন।
আর আমার রুমমেটও মাস্টার্স পাস করার পর একবার বিসিএস দিয়েছিল। কিন্তু চান্স পায়নি। বড় ভাইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সে এরপর আর অপেক্ষা না করে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে যোগ দিয়ে গ্রামে চলে যায়। এরপর সে আর কখনো বিসিএসের জন্য চেষ্টা করেনি।
কোটা সংস্কার নিয়ে আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা বেশ কয়েকজন চাকরি প্রার্থী এ প্রতিবেদককে বলেন, একজন ছাত্র যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা এ ধরনের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় তখন তাকে নিয়ে তার আত্মীয়স্বজন, পাড়া- প্রতিবেশী এবং এলাকার পরিচিতরা অনেক স্বপ্ন দেখেন।
কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া আসলেই অনেক সৌভাগ্যের বিষয়। তাই তাদের পরিচিত সবাই ভাবতে থাকেন একদিন সে বড় কিছু হবে। পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও গ্রামের মুখ উজ্জ্বল হবে। ছাত্র অবস্থায় তাকে সবাই বিশেষ দৃষ্টিতে দেখে। কিন্তু পড়ালেখা শেষে অনেকের ক্ষেত্রে এসব স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে যায়।
কারণ শিক্ষাজীবনে মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও অনেকে জীবনের ক্ষেত্রে গিয়ে ভালো কিছু করতে পারে না। এর জন্য আসলে কে বা কারা দায়ী? মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা কতটা দায়ী? অনেক কারণ থাকলেও আমরা আমাদের চোখের সামনে যেটা দেখতে পাচ্ছি তা হলো কোটা, দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি আর ঘুষসহ নানা অনিয়মের কারণে সবার চোখের সামনে অনেক অযোগ্য আর অমেধাবী লোকজন ভালো ভালো চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অনেক মেধাবী এসব পদে চান্স না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছেন।
এ অবস্থা আর চলতে পারে না। এর অবসান হওয়া দরকার।
কেউ কেউ বলেছেন, কোটা সংস্কার হলেই যে, সব মেধাবী আর যোগ্যরা সরকারি ভালো ভালো পদে চান্স পেয়ে যাবে সেটিও ঠিক নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ পদে সবচেয়ে মেধাবী আর যোগ্য প্রার্থীরা চান্স পাবে এটিই হওয়া উচিত।
এরপরও যেসব মেধাবী যোগ্যরা পদের স্বল্পতার কারণে চান্স পাবেন না তারাও যাতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান তার নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকেই করতে হবে। রাষ্ট্র যদি তার মেধাবী সন্তানদের দেশের কাজে লাগাতে না পারে আর তারা যদি হতাশায় ভোগেন তাহলে এ জাতির ভবিষ্যৎ ভালো হবে কেমন করে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা অগণিত মেধাবী তরুণ রয়েছেন যাদের স্বপ্ন ছিল জীবনে ভালো একটি চাকরি করা। কিন্তু নানা কারণে তারা সে স্বপ্ন থেকে বঞ্চিত হয়ে অনেকে সামান্য ছোট-খাটো কিছু একটা করে জীবন পার করছেন।
অনেকে এমন অনেক কাজ করছেন যার সাথে শিক্ষা জীবনের বিষয়ের সাথে কোনো মিল নেই। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা অগণিত তরুণ জীবনে সরকারি চাকরি না পেয়ে বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করছেন সামান্য বেতনে। এমনকি অনেকে বেসরকারি হাইস্কুলেও শিক্ষকতা করছেন নগন্য বেতনে। উচ্চ শিক্ষিত মেধাবী তরুণদের এ চিত্র কোনো জাতির জন্য শুভকর হতে পারে না।