তারুণ্যের জোয়ারে ভেসে চলছে দেশের নতুন প্রজন্মের কয়েক কোটি মানুষ। লেখাপড়া কিংবা উপার্জন কিংবা ব্যক্তিগত নানা ভালোলাগা-ভালোবাসার রঙিন স্বপ্নে বিভোর একেকজন। অল্প দিন পরেই তাঁরা একে একে পা বাড়াবেন জীবনের নতুন অধ্যায়ে। বসবেন বিয়ের পিঁড়িতে। হেসে খেলে এগিয়ে যাবেন সামনের দিকে। নিজের স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত করে নেবেন আরেক প্রজন্ম; সন্তানের স্বপ্নকে।
এতো কিছু ছাপিয়ে নতুন প্রজন্মের সময় কই—নিজের শরীরে কোনো সুপ্ত বিপদ লুকিয়ে আছে কীনা তা খুঁজে দেখার! তবে এখন সময় এসেছে নিজের জন্য না হলেও নিজের পরবর্তী প্রজন্মকে বিপদমুক্ত ভাবে পৃথিবীতে আসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য নিজের শরীরের আগাম খোঁজ খবর রাখার। আর এমন খোঁজখবরই কেবল ভয়ানক থ্যালাসেমিয়া থেকে রক্ষা করতে পারে সমাগত একেকটি জীবনকে।
এজন্য বিয়ের আগেই এখন জরুরি হয়ে পড়েছে সবার রক্তের পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া এবং সে অনুসারে পরবর্তী জীবনের পরিকল্পনা করা। এমনসব সচেতনতার আহবান নিয়েই আগামীকাল মঙ্গলবার দেশে পালিত হবে বিশ্ব থ্যালাসিমিয়া দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য— বিয়ের আগে পরীক্ষা করলে রক্ত, সন্তান থাকবে থ্যালাসেমিয়া মুক্ত।'
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, বাবা-মা থ্যালাসেমিয়ার বাহক হলে সন্তান থ্যালাসেমিয়ার রোগী হয়ে জন্ম নেবে। দেশে যেমন প্রতিবছর গড়ে ৭ হাজারেরও বেশি সংখ্যক শিশু এই ঘাতক ব্যাধি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
বাংলাদেশে এ রোগের বাহক বা আক্রান্ত রোগীর সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ১০ লাখ মানুষই থ্যালাসেমিয়ার বাহক। তবে বাহক থাকলেই তাঁদেরকে থ্যালাসেমিয়া রোগী বলা যাবে না। আর বর্তমানে এদেশে প্রায় ৬০ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগে ভুগছে।
আর বিশ্বে থ্যালাসেমিয়ার বাহক সংখ্যা প্রায় ২৫০ মিলিয়ন। আর এ রোগ থেকে পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে বিয়ের আগে বর ও কনের রক্ত পরীার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে যে তারা কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক বা রোগী কিনা।
যদি দুজনেই বাহক বা একজন বাহক অন্যজন রোগী হয় তাহলে তাদের সন্তানও এই ঘাতক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি তাই তাদের না বিয়ে করাই উত্তম। এছাড়া গর্ভাবস্থায় শিশুর ভ্রুন পরীক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, আগে দেশে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে কাজ ঢিলেঢালা ভাবা চললেও আমরা চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া নির্মূলে একটি জাতীয় কার্যক্রম শুরু করেছি।
এ কার্যক্রমের আওতায় প্রতিবছর ১০ জানুয়ারি দেশে থ্যালাসেমিয়া সচেনতায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হবে। এছাড়া এখন থেকে এ রোগের ব্যাপারে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষন দেওয়া ও জনসাধারনের মধ্যে সচেতনতা তৈরি, থ্যালাসেমিয়ার বাহক ও রোগীদের নিবন্ধন করার, বিয়ে রেজিস্টারদের সচেতন করার মতো কাজ চলবে। এমনকি পর্যায়ক্রমে আমরা বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা অপরিহার্য করার বিষয়টি আইনে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েও ভাবনা শুরু হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক ডাঃ মোঃ সালাহউদ্দীন শাহ্ বলেন, থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তের রোগ। থ্যালাসেমিয়া শব্দের উত্পত্তি গ্রীক শব্দ থ্যালাসা থেকে এসেছে যার অর্থ সমুদ্র।
ভূমধ্যসাগর সন্নিহিত অঞ্চলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। এজন্য একে থ্যালাসেমিয়া বলে। এই রোগে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন কণার উত্পাদনে ত্রুটি হয়। থ্যালাসেমিয়া ধারণকারী মানুষ সাধারণত রক্তে অক্সিজেন স্বল্পতা বা অ্যানিমিয়াতে ভুগে থাকেন।
অ্যানিমিয়ার ফলে অবস্বাদগ্রস্থতা থেকে শুরু করে অঙ্গহানি ঘটতে পারে। বাবা অথবা মা কিংবা বাবা-মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়ার জীন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়। এ রোগ কোন ছোঁয়াচে নয়। জীনগত ত্রুটির কারণে এই রোগ হয়ে থাকে।
ডাঃ মোঃ সালাহউদ্দীন শাহ্ বলেন, এক-দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ঠিকমত চিকিত্সা না করলে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বিশ্বে বিটা থ্যালাসেমিয়ার চেয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি।
উপসর্গ : এ রোগের কিছু উপসর্গ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা জানান, দূর্বলতা, অবসাদ অনুভব, অস্বস্তি, মুখ-মণ্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, গাঢ় রঙের প্রস্রাব হওয়া, ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস), মুখের হাড়ের বিকৃতি, পেট বাইরের দিকে প্রসারিত হওয়া বা বৃদ্ধি পাওয়া, ধীরগতিতে শারীরিক বৃদ্ধি হূদপিন্ডের সমস্যা, অতিরিক্ত আয়রণ, সংক্রমন, অস্বাভাবিক অস্থি।
এ ধরনের উপসর্গ কারো মধ্যে দেখা গেলে দ্রুত চিকিত্সকের কাছে যেতে হবে। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হয়। প্রয়োজনবোধে ওষুধ এবং রক্ত গ্রহণ করতে হয়। তাই এই রোগের চিকিত্সা অনেক ব্যয় বহুল। এই রোগে আক্রান্ত রোগীকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চিকিত্সা সেবা গ্রহণ করতে হয়।
এই রোগের স্থায়ী চিকিত্সা হচ্ছে ‘ব্যোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন’ যা অত্যন্ত ব্যয় বহুল। বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীর পইে এটি করা সম্ভব নয়। তাই থ্যালাসেমিয়া রোগটির প্রতিকার করা সম্ভব একমাত্র জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে।
এই রোগ সম্পর্কে মানুষের বিস্তারিত ধারণা থাকলে এর পরিপূর্ণ প্রতিকার সম্ভব হবে।