ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, হার্ভার্ডসহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ দেখা যায়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে প্রথম সারিতে আছে। অন্যদিকে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ের একেবারে পেছনের সারিতে বা অনেক ক্ষেত্রে না থাকায় সবার মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করে।
কিন্তু আমরা অনেকেই হয়তো জানি না ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে কীভাবে জায়গা করে নিতে হয়। হতে পারে এটি অজ্ঞতা অথবা পদ্ধতি জানা থাকলেও তা এড়িয়ে যাওয়া। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উৎকর্ষের চেয়ে এখন আমরা প্রশাসনিক দিককেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। ফলে পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষার উৎকর্ষের বিষয়টি সেভাবে ভাবা হয় না। যদিওবা শিক্ষা পরিকল্পনা থাকে, তবে তা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। আর নজরদারির সংস্কৃতি আমাদের দেশে নেই বললেই চলে।
তবে এখন সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে পৃথিবীর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে হয়। প্রতিযোগিতার বিষয়টি সময়ের সঙ্গে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এ জন্য দরকার শিক্ষার গুণগত মান বজায় রেখে ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে প্রথম সারিতে জায়গা করে নেওয়া। এখন জানা দরকার কীভাবে অগ্রসর হলে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে জায়গা করে নিতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বজনীন কর্মক্ষমতা নির্ধারণের একটি স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান। যারা গবেষণার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পর্যবেক্ষণ করে এগুলোর শিক্ষা, গবেষণা, জ্ঞানের আদান-প্রদান ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়গুলো বিচার-বিশ্নেষণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে র্যাংকিং করার ক্ষেত্রে এরা ছয়টি উপাদানকে চিহ্নিত করেছে।
এ ছয়টি উপাদান হচ্ছে- শিক্ষাদান, গবেষণা, সাইটেশন বা গবেষণার সংখ্যাতাত্ত্বিক প্রভাব, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও শিল্প-কারখানার সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে শিল্প আয়। এসব উপাদান পেশাদার প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্সের নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র অডিটের মাধ্যমে যাচাই করা হয়।
যেসব বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করে না এবং যাদের বিগত চার বছরে এক হাজারের কম আর্টিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয়, তাদের ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে বিবেচনা করা হয় না। এ ছাড়া র্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে আরও যেসব উপাদান রয়েছে তা যথাযথভাবে পূরণ না হলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়কে বাদ রাখা হয়। এর পর বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর র্যাংকিংয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। শিক্ষাদানের গুণগত মানের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ প্রভাব বিবেচনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে শেখার পরিবেশের দিকটি একটি প্রধান বিবেচ্য বিষয় হিসেবে দেখা হয়।
এই শিক্ষাদানের মধ্যে ৫টি উপাদান যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম, স্টাফ ও ছাত্রের অনুপাত, ডক্টরেট ও ব্যাচেলরের অনুপাত, ডক্টরেট প্রদান ও শিক্ষা সংশ্নিষ্ট স্টাফদের অনুপাত, প্রতিষ্ঠানের আয় এই বিষয়গুলোতে যথাক্রমে ১৫ শতাংশ, ৪.৫ শতাংশ, ২.২৫ শতাংশ, ৬ শতাংশ এবং ২.২৫ শতাংশ নম্বর বা প্রভাবের বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়।
শিক্ষাদানের পরের বিষয়টি হলো গবেষণা, যার প্রভাব বা নম্বর হচ্ছে ৩০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে গবেষণার সুনাম, গবেষণালব্ধ আয় ও গবেষণার পরিমাণের প্রভাব যথাক্রমে ১৮ শতাংশ, ৬ শতাংশ ও ৬ শতাংশ। গবেষণার সঙ্গে আরেকটি বিষয় পারস্পরিকভাবে যুক্ত, সেটি হলো সাইটেশন বা গবেষণার সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্নেষণ, যার প্রভাব ৩০ শতাংশ। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে আরেকটি উপাদান, যার প্রভাব ৭.৫ শতাংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এখানে মূলত তিনটি বিষয় মুখ্য। সেগুলো হলো- আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ছাত্রের অনুপাত, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় স্টাফদের অনুপাত ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা; যেগুলোর প্রভাব যথাক্রমে ২.৫ শতাংশ, ২.৫ শতাংশ ও ২.৫ শতাংশ বলে ধরে নেওয়া হয়। অন্য উপাদানটি হচ্ছে শিল্প-কারখানা থেকে অর্জিত আয়ের প্রভাব ২.৫ শতাংশ।
টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং করে থাকে, তেমনি কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং করার ক্ষেত্রে একটি পরিকল্পিত পদ্ধতি মেনে চলে। এই পরিকল্পিত পদ্ধতি ছয়টি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল- শিক্ষাক্ষেত্রে সুনাম, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্রদের কর্মক্ষেত্রে সুনাম, শিক্ষক ও ছাত্রের অনুপাত, প্রতি শিক্ষকের যে গবেষণাপত্র বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয় তার সাইটেশন, দেশি-বিদেশি শিক্ষকদের অনুপাত এবং দেশি-বিদেশি ছাত্রদের অনুপাত। র্যাংকিং করার ক্ষেত্রে এই ছয়টির প্রভাব যথাক্রমে ৪০ শতাংশ, ১০ শতাংশ, ২০ শতাংশ, ২০ শতাংশ, ৫ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ের মধ্যে আসতে পারে।
এখানে যে দুটি প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং করে থাকে তাদের শর্তগুলো যদি পূরণ করা সম্ভব হয়, তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ের সামনের সারিতে জায়গা করে নিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে আসতে পারছে না। এর অর্থ এই, যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারিত হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। আবার ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাজানো দরকার ছিল, তা বিবেচনা করা হয়নি।
যদি আমরা র্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে বিষয়গুলোকে বিশ্নেষণ করি, তবে এখানে কয়েকটি বিষয় আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই আসে শিক্ষাদান। এই শিক্ষাদান বিশ্বমানের হতে হবে। আশার কথা হচ্ছে, সরকার শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাশুরেন্স সেলের কার্যক্রম শুরু করেছে। আবার এটিকে চূড়ান্তভাবে বিশ্নেষণ করার জন্য বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিয়েশন বোর্ড গঠন করেছে। যাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার সনদকে বিশ্বমানে উন্নীত করা।
এটি দেশের মধ্যে শিক্ষার গুণগত মান পরীক্ষার মাধ্যমে সনদের গুণগত মান যাচাইয়ের একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এটিই যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে ওয়াশিংটন অ্যাকোর্ডের মতো প্রতিষ্ঠানেরও শিক্ষার গুণগত মান যাচাইয়ের সুযোগ থাকতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে গবেষণা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বর্তমান সরকার গবেষণাকে সংস্কৃতিতে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে, যেটি আশাব্যঞ্জক।
কিন্তু গবেষণার পরিবেশ ও মানসিকতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছে কি-না বা তা কীভাবে পরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তার কোনো ধরনের নজরদারির প্রক্রিয়া নেই। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে শিক্ষকের অনুপাত অনুযায়ী কতগুলো গবেষণাপত্র প্রকাশ হওয়া দরকার- কী কী ধরনের গবেষণা হওয়া উচিত, শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কীভাবে গবেষণায় যুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাকে এগিয়ে নেওয়া যায়, তারও কোনো বাস্তবসম্মত পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া নেই।
এখানে একটি পরিকল্পনার কথা বলা যেতে পারে। সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেবে। এর বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের গবেষণা পরিকল্পনাকে কীভাবে সাজাবে, তার একটি ফিডব্যাক প্রক্রিয়া থাকতে হবে। এ ছাড়া গবেষণাপত্রগুলো যে জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে, তার গুণগত মানের বিষয়টিও ভেবে দেখতে হবে। এর প্রধান কারণ হলো যদি কোনো গবেষণাপত্র ভালো মানের জার্নালে প্রকাশিত হয়, তবে তা দেশ-বিদেশের গবেষকরা তাদের গবেষণা প্রবন্ধে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করেন।
এ ধরনের ব্যবহার যত বাড়বে, সাইটেশনও তত বাড়বে। ফলে শিক্ষা, গবেষণা ও সাইটেশনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র্যাংকিংয়ের প্রস্তাবকৃত প্রভাবের মধ্যে আসতে সক্ষম হবে। শিল্প-কারখানা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের কথা এ ধরনের র্যাংকিংয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে তেমনটি হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ, শিল্প-কারখানাগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি রয়েছে এক ধরনের আস্থাহীনতা।
শিল্প-কারখানার মালিকরা মনে করেন, আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে কোনো একটি সমস্যা সমাধানের দক্ষতা গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম, সেটিও তারা শিল্প-কারখানাগুলোর কাছে পৌঁছাতে পারছে না। এর ফলে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এনে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করা হচ্ছে, যা একটি রাষ্ট্রের জন্য কোনোভাবেই কল্যাণকর নয়। এখন দরকার শিল্প-কারখানাগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা।
এগুলো ছাড়াও অন্য যেসব বিষয় রয়েছে, সেগুলোকে সম্পৃক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে সাজানো হলে আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে জায়গা করে নেবে, এটি বলা যায়। তবে এ জন্য দরকার আমাদের ইতিবাচক ভাবনা ও মানসিকতার পরিবর্তন। এর সঙ্গে শিক্ষা যে একটি বিনিয়োগ এবং এর মাধ্যমে যে জাতির সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি নিশ্চিত করা সম্ভব, তার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা। এ জন্য সবাইকেই গতানুগতিক ধারণা পরিবর্তন করে আধুনিক ধারণাকে গ্রহণ করতে হবে। তবেই আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে জায়গা করে নিতে পারবে।
asadzmn2014@yahoo.com
অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর