সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের ব্যবহার মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজতর করেছে। বিশ্বের যেকোনো স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বন্ধুদের কাছে টেনে নেয়ার মতো সুযোগ এই মাধ্যমটিই করে দিয়েছে।
সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো- মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কিছু ভালো সময় কাটানোর একটি অন্যতম প্ল্যাটফরম ফেসবুকই। আর সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তবে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের এ জায়গাটি যতই মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে ততটাই নেতিবাচক প্রভাবও ফেলেছে। প্রতিনিয়ত অসংখ্য মানুষ প্রচুর সময় ব্যয় করার পাশাপাশি ফেসবুকে থেকে নিজেরা হতাশায় ভুগছেন- এমনটাই মনে করছেন গবেষকরা।
বিভিন্ন সমাজ বিজ্ঞানী ও গবেষক বলছেন, ফেসবুক মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনলেও এর থেকে প্রভাবিত হয়ে হতাশ হচ্ছেন অনেকে। বিশেষ করে এ হতাশা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তরুণ সমাজের মাঝে বেশি লক্ষণীয়। দেখা যায়, কেউ সারাদিন ব্যস্ততার পর বাড়ি ফিরে ফেসবুক অনলাইনে আসেন।
ওয়াল ঘুরে দেখলেন কাছের বন্ধুদের অনেকে কোথাও ঘুরতে গিয়েছেন সেসব ছবি, যেখানে তার থাকার কথা থাকলেও পারেননি। আবার অনেকে আছেন অনলাইনে প্রায়ই কোনো এক বন্ধুর সঙ্গে চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত। কিন্তু হঠাৎ তিনি লাপাত্তা। তার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েও পারছেন না। এর থেকে হতাশায় ভোগেন তারা।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাইম জানান, গত এক মাস ধরে ফেসবুক আইডি ডিঅ্যাক্টিভেট করে রেখেছি। ফেসবুক অনলাইনে থাকলে মাঝে মাঝে অলস সময় কাটানো যায়। কিন্তু এর থেকে বড় সমস্যা হলো- প্রায়ই হতাশ হয়ে যাই। বন্ধুবান্ধবের অনেকের অ্যাক্টিভিটি দেখি। নানা কারণে সেসবে অংশ নিতে পারি না। নিউজফিডে সবার কাজকর্ম দেখে সময়গুলোতে অস্থিরতা কাজ করে।
আফসার নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ফেসবুক যতটা আমাদের জীবনকে সহজ করে তুলেছে ততটাই খারাপ প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে চ্যাটিংয়ে অনেকের সঙ্গে কথা হয়। দেখা যায়, যে বন্ধুকে বেশি ভালো লাগে তার সঙ্গে হঠাৎ কথোপকথন বন্ধ হয়ে গেলে ভীষণ খারাপ লাগে।
এ সময় খানিকটা একাকিত্ব অনুভব করি। সারাদিন কাজকর্ম শেষ করে এসে যদি দেখি ওই ভালোলাগার বন্ধুটি অনলাইনে নেই তখন সত্যিই খুব বিষণ্নতায় ভুগি। এসব কারণে অনেক দিন হয় সামাজিক যোগাযোগের এ মাধ্যমটিতে খুব একটা আসা হয় না।
ওহিও স্টেট ইউনির্ভাসিটির জ্ঞাপন বিভাগের অধ্যাপক সিলভিয়া নবলক ওয়েস্টারইউক বলছেন, যখন আপনি ভালো মুডে থাকেন, তখন আপনি সেলিব্রিটিদের ফলো করতে ভালোবাসেন। কিন্তু যখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তখন আপনি সাধারণ মানুষদের জীবনেও আগ্রহ দেখান। যারা আপনার মতো কোনো না কোনোভাবে ভেঙে পড়েছেন তাদের প্রতি আপনার সহানুভূতি জন্মায়।
এই সমীক্ষা আরো জানাচ্ছে, ফেসবুকের প্রতি অত্যধিক আগ্রহ ব্যবহারকারীদের খিটখিটে করে দেয়। কারণ, এক সময় বন্ধুদের কাছ থেকে তাদের সাফল্যের আপডেট পেতে পেতে আপনার নিজেকে একা, পিছিয়ে পড়া, হেরে যাওয়া বলে মনে হতে পারে। তাই কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করবেন তা নিয়ে সাবধান। সমীক্ষা বলছে, মন খারাপের সময় আপনি সেই সমস্ত মানুষদের প্রোফাইল বেশি ভিজিট করেন যারা আপনার থেকেও বেশি পিছিয়ে রয়েছে বা কম সাফল্যের মুখ দেখেছে।
গত কয়েক বছরে এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। এ রকমই কিছু গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে এবং মনোবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা আইএএনএস।
সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একাকিত্ব নিয়ে আমাদের সাধারণ ধারণা হচ্ছে বয়স হলে মানুষ একা হয়ে যায়। কিন্তু কম বয়সী কিশোর-কিশোরীরাও দিন দিন একা হয়ে যাচ্ছে ফেসবুকের কারণে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা বেড়েই চলছে। ফেসবুকে আসক্তির কারণে কিশোর-কিশোরীরা অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে একাকী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। আর এই একাকিত্ব থেকে বাড়ছে হতাশা। দীর্ঘদিনের হতাশা থেকে তারা হয়ে পড়ছে আত্মহত্যাপ্রবণ।
দিল্লির ফরটিস হেলথ কেয়ার হাসপাতালের মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড বিহ্যাভিরিয়াল সায়েন্সেসের পরিচালক ডা. সামির পারিখ জানিয়েছেন, একাকিত্ব শারীরিক ও মানসিক দুদিক দিয়েই রোগীদের ক্ষতি করে।
এরা আস্তে আস্তে সবার থেকে দূরে সরে যায় এবং তাদের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে নয়াদিল্লির সরোজ সুপার স্পেশালিটি হসপিটালের কনসালটেন্ট ডা. সন্দীপ গোভিল বলেন, তনয় নামের ১৪ বছর বয়সী এক ছেলে আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ফেসবুকে সে এতটাই আসক্ত ছিল যে ফোন বন্ধ করে রাখলে সে অস্থির হয়ে পড়তো।
আমরা তার এই ‘স্ক্রিন এডিকশন’-এর চিকিৎসা শুরু করি। তখন ব্যবস্থা নেয়া না হলে এই আসক্তি থেকে সে আরো বড় কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারতো।
ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া-লস অ্যাঞ্জেলেসের গবেষকরা বিষয়টি নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। সেখানে তারা উল্লেখ করেছেন, একাকিত্বের ফলে মস্তিষ্কে বিপজ্জনক সিগন্যাল পৌঁছায়। যার ফলে হোয়াইট ব্লাড সেলের উৎপাদন ব্যাহত করে। তাই একাকিত্ব থেকে শারীরিক অসুস্থতার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
তবে এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান ভিন্ন মতই পোষণ করেন। তিনি বলেন, মানুষ একা হয়ে যাচ্ছে, হতাশ হচ্ছে এসবের জন্য ফেসবুককে দোষ দেয়া যাবে না। আসল কারণ কোনটা সেটা খুুঁজে বের করতে হবে।
আমার কাছে যেটা মনে হয়, মানুষ অতিমাত্রায় আয়মুখী ও ভোগবাদী হয়ে উঠেছেন। মানুষের জীবনযাত্রায় ফেসবুক একটা কম্পোন্যান্ট মাত্র। এখানে মানুষ বরং কিছু কোয়ালিটি টাইম পাস করছে। আসলে ফেসবুকে মানুষ কি করে? ছবি পোস্ট করে, স্ট্যাটাস দেয়, অন্যদের ছবি দেখে, অন্যদের ছবি-স্ট্যাটাসে লাইক কমেন্ট করে! এখানে ফেসবুকের দোষের কিছু দেখছি না। মূল সমস্যা হচ্ছে- ওই যে বললাম, মানুষের উপার্জনমুখী মনোভাব এবং ভোগবাদিতা। আর নৈতিক শিক্ষা।