সরকারের শেষ বছরে মন্ত্রী-এমপিদের খুশি করতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের হিড়িক পড়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ‘বাণিজ্য’ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলেও সরকার একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় চরম অরাজকতার মধ্যেই গতকাল গোপনে নতুন দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। গত দেড় মাসে এনিয়ে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হলো। আরো অন্তত ডজনখানেক বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম-সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়-১) মো. বেলায়েত হোসেন তালুকদার বলেন, নতুন দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দিতে গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পাওয়া গেছে।
দুদিন আগে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার পরেও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারবো না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয় দুটির একটি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি। এটি বরিশাল শহরের নবগ্রাম রোডে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এর উদ্যোক্তা কাজী সফিকুল ইসলাম। নেপথ্যে রয়েছেন বরিশাল-২ আসনের এমপি তালুকদার মো. ইউনুস।
অপরটি হলো ইউনিভার্সিটি অব স্ট্যান্ডার্ড। এটি রাজধানীর মহাখালীর সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম চালাবে। এর উদ্যোক্তা ইঞ্জিনিয়ার একেএম মোশাররফ হুসাইন। এ নিয়ে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৩টি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে সরকারের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন। তারা এতটাই প্রভাবশালী যে, একদিনের মধ্যে ফাইল উঠিয়ে অনুমোদন নিয়েছেন।
অথচ সরকারের অনেক মন্ত্রীও বছরের পর বছর ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা অন্যদের দেখানো হলেও পেছনে রয়েছে মন্ত্রী-এমপিসহ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ এর ৩৬ ধারা অনুযায়ী ২৩ শর্তে বিশ্ববিদ্যালয় দুটির সাময়িক অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
আইনের ৭-এর ১ ও ২ ধারা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে ২৫ হাজার বর্গফুট আয়তনের নিজস্ব বা ভাড়া করা ভবন, অন্তত তিনটি অনুষদ ও ছয়টি বিভাগ, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, ছাত্রছাত্রীদের জন্য কমনরুম, সেমিনার কক্ষসহ পর্যাপ্ত অবকাঠামো থাকতে হবে। সরকারের পূর্বানুমোদন ছাড়া বিভাগ খোলা যাবে না। শর্তানুযায়ী নির্দিষ্টসংখ্যক পূর্ণকালীন শিক্ষক থাকতে হবে।
চ্যান্সেলরের (প্রেসিডেন্ট) পূর্ব অনুমোদন ছাড়া বিদেশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা যাবে না। আরোপিত শর্তগুলোর ওপর ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে অঙ্গীকারনামা দিতে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৪৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। গত বছর কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়নি সরকার। সর্বশেষ ২০১৬ সালে ‘আনোয়ার খান মর্ডান ইউনিভার্সিটি’র অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
তখন ঢাকায় আর কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন না দেয়ার ব্যাপারে সরকারের একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত ছিল। তা লঙ্ঘন করে গত ২৯শে জানুয়ারি ‘জেড এন আর এফ ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়’-এর অনুমোদন দেয়া হয়েছে। গুলশানে এটি স্থাপন করা হবে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ড. এম জুবায়দুর রহমান।
এছাড়া গত ২৫শে এপ্রিল রাজশাহী ও বান্দরবানে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যথাক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় দুটি হলো- ‘শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনির্ভাসিটি’ ও ‘বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়’। গত ১৬ই এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ ‘খুলনা খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়’ ও ‘আহছানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’র অনুমোদন দিয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয় দুটি যথাক্রমে খুলনা ও রাজশাহীতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবে। বিশ্ববিদ্যালয় দুটির উদ্যোক্তা ঢাকা আহছানিয়া মিশনের প্রেসিডেন্ট কাজী রফিকুল আলম। এর আগে তিনি ‘আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’র অনুমোদন নিয়ে পরিচালনা করছেন।
ইউজিসির এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকারদলীয় মন্ত্রী-এমপি ও রাজনৈতিক নেতারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পেতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সরাসরি আবেদন করেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গ্রিন সিগন্যাল আসায় ইতিমধ্যে ইউজিসি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এরমধ্যে বিরোধীদলীয় নেতার নামে ‘রওশন এরশাদ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ’ উদ্যোক্তা আবুল হোসেন নামে একজন শিক্ষা ব্যবসায়ী রয়েছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিলে সনদ ব্যাণিজ্যের আশঙ্কা থাকায় ইউজিসি নেতিবাচক পরিদর্শন প্রতিবেদন দিয়েছে।
তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ফের প্রতিবেদন পাঠাতে গত মার্চ মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে। এটিও যেকোনো সময় অনুমোদন পেতে পারে।