অধ্যাপক ড. ফরিদ সোবহানী

মহামারী করোনা কেড়ে নিলো আরেকটি আলোকিত প্রাণ, পতন হলো শিক্ষা জগতে আরেকটি নক্ষত্রের।‌ ইহজগত থেকে চিরবিদায় নিলেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ প্রফেসর নূরুদ্দীন চৌধুরী।‌ তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সফল উপাচার্য। চট্টগ্রামের সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি উপাচার্যের পদ অলংকৃত করেছিলেন। দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে তিনি ছিলেন সৎ, নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক। যে কয়জন মহৎ ব্যক্তির সান্নিধ্য আমার পেশাগত জীবনের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছে তাদের মধ্যে প্রফেসর নূরুদ্দীন স্যার অন্যতম।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে স্যারের সরাসরি ছাত্র হতে না পারলেও একজন সহকর্মী হিসেবে তাঁর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পেয়েছি। আইআইইউসি'র এমবিএ প্রোগ্রামের তিনি যখন প্রতিষ্ঠাতা কো-অর্ডিনেটর, শিক্ষকতার পাশাপাশি আমি তখন অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহরস্থ ক্যাম্পাসে একই রুমে আমি স্যারের পাশেই বসতাম।

এভাবে কাটিয়েছিলাম প্রায় দু'বছর। স্যারের কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখেছি। বিভিন্ন মিটিং‌‌ কল করা, রেজুলেশন লেখা, ফ্যাকাল্টিদের সাথে যোগাযোগ রাখা এবং চিঠির ড্রাফটিং করা ইত্যাদি কাজগুলো আমাকে করতে হতো। স্যারের পরামর্শে বিভিন্ন কাজগুলো চমৎকারভাবে সম্পন্ন করার সুযোগ পেতাম। বিভিন্ন ড্রাফট স্যারকে দেখাতাম। স্যার নিজ হাতে ড্রাফটগুলো সংশোধন করে দিতেন‌।

ইংরেজি ভাষায় স্যারের ছিল অসাধারণ দখল। চমৎকার ছিল তাঁর শব্দচয়ন। অনেক শব্দের যথাযথ ব্যবহার স্যারের কাছ থেকেই শিখেছি।

ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়নে স্যারের অবস্থান থাকতো শীর্ষে। টিচিং ইফিশিয়েন্সি রেটিং (Teaching Efficiency Rating)- এ তিনি একাধিকবার ১০০% স্কোর করেছেন- যা একেবারেই বিরল! উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন থাকতেন। শিক্ষার মানের সাথে কম্প্রোমাইজ না করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি ছিলেন পজেটিভ মন মানসিকতার অধিকারী।

ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে প্রায়ই গল্প করতেন। ফাইনাল পরীক্ষার আগে একদিন ছাত্রছাত্রীরা তার ক্লাসে সাজেশন দাবি করলো। তিনি বিরক্ত না হয়ে ছাত্রছাত্রীদেরকে বললেন, "ওকে পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নগুলো লিখো"। এক এক করে সম্ভাব্য প্রশ্নের তালিকা যখন একশ'র কাছাকাছি তখন ছাত্রছাত্রীরা বলতে লাগলো "স্যার, আর সাজেশন লাগবে না"। শিক্ষকতা পেশায় স্যারের এমন অনেক আচরণ ছিল আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। ‌

স্যারের স্নেহ ও অমায়িক আচরণ কোনো দিন ভুলার মতো নয়। তিনি অনেক কিছুই প্রিয় সহকর্মীদের সাথে শেয়ার করতেন। একদিন সীতাকুণ্ডে কৃতি ছাত্রছাত্রীদের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি প্রধান অতিথি ছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে আমি ছিলাম সে অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি। আমি তখন আইআইইউসি'র বাণিজ্য শিক্ষা অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। নিমন্ত্রণ কার্ডে আমার নাম দেখে স্যার খুশি হয়ে আমাকে ফোন দিলেন এবং ‌বললেন "সোবহানী, তুমি আমার সাথে যেও।" স্যারের সেই স্নেহমাখা কথাগুলো এখনো যেন আমার কানে বাজছে। ‌

সেদিনের প্রায় সারাবেলাই কেটে গেলো স্যারের সাথে। সমসাময়িক অনেক কিছুই তিনি আমার সাথে শেয়ার করছিলেন। একটি কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "স্যার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি'র দায়িত্ব আপনার কেমন লাগছে?" স্যার বলেছিলেন, "ভিসি'র দায়িত্ব নেয়ার সময় অনেক কিছুই করবো ভেবেছিলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নোংরা রাজনীতির কারণে তেমন কিছুই করতে পারছি না।" অতঃপর স্যার একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‌

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নোংরা রাজনীতি এখনো অনেকের দীর্ঘশ্বাসের কারণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশকে মারাত্মকভাবে কলুষিত করছে।‌ ‌মনে প্রশ্ন জাগে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী এহেন অবস্থা থেকে কখনোই পরিত্রান পাবে না? ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ কী কখনোই সংশোধিত হবে না?

প্রফেসর নূরুদ্দীন চৌধুরী স্যারের মৃত্যুতে অনেক স্মৃতিকথাই মনে পড়ছিলো। স্মৃতির পাতা থেকে ক'টি কথা শেয়ার করলাম। ‌মহান আল্লাহ পরম শ্রদ্ধেয় স্যারের ভালো কাজগুলো কবুল করুন এবং তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন। আমীন।

[ড. ফরিদ সোবহানীঃ অধ্যাপক ও ডাইরেক্টার, এমবিএ প্রোগ্রাম, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ঢাকা। তার ফেসবুক প্রোফাইল: https://www.facebook.com/farid.sobhani.52]

 


Comments