অধ্যাপক ড. জুলফিকার হাসান

একজন শিক্ষক মানেই একজন একাডেমিক লিডার। বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে “নেতৃত্ব” সবচেয়ে বেশী আলোচিত বিষয়। দিনের বড় একটা অংশই এই নেতৃত্বকে কাটাতে হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের সাথে। কাজের জায়গাটাই হয়ে যায় তাদের সেকেন্ড হোম। অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটানোর ফলে পরিবারের পরে সহকর্মীরাই তাদের আপনজন হয়ে উঠেন। প্রতিষ্ঠানের উন্নতি বা অবনতি, সুনাম বা দুর্নাম এর সাথে জড়িয়ে যায় একাডেমিক নেতৃত্বের ভূমিকা। নেতৃত্বের দক্ষতা, গতিশীলতা, দৃষ্টিভঙ্গি, পেশাদারীত্ব, বৃদ্ধিমত্তা ও ঝুকিঁ নেওয়ার মানসিকতা প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ধারন করে দেয়।

একাডেমিক নেতৃত্বে কারা থাকেন?

সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উপাচার্য (ভাইস চ্যান্সেলর) একাডেমিক নেতৃত্বের শীর্ষে থাকেন। তারপরেই প্রোভিসি, অনুষদের ডীন, বিভাগীয় প্রধান, নিয়োগকর্তা, প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর, শিক্ষক এবং বিভিন্ন একাডেমিক কমিটির কনভেনার একাডেমিক নেতৃত্বের অংশ হয়ে থাকেন। আর এদের সবাইকে দিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য থাকেন পরিচালনা পর্ষদ (বোর্ড অব ট্রাস্টিজ), সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল ইত্যাদি।

আগাতে হয় সকলকে নিয়েই

একাডেমিক লিডার হিসাবে প্রতিষ্ঠান, সহকর্মী ও ছাত্র-ছাত্রীদের এগিয়ে নেওয়াটাই হওয়া চাই মূল লক্ষ্য। দরকার একটি শক্তিশালী আন্তরিক পরিবেশ তৈরী করা। কেবল সামনে নয়, পেছন থেকেও নেতৃত্ব দিতে হয়। প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সফলতার বিষয়টিও একাডেমিক নেতৃত্বের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার সাথে যারা জড়িত তাদের মনোভাবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হয় একাডেমিক নেতৃত্বকে। আর সেজন্য মনোযোগ দিতে হবে কয়েকটি বিষয়ের উপর।

স্বস্তিদায়ক ও নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিত্ব

আপনি কি অনেক ভারী ব্যক্তিত্বের অধীকারী? পাল্টে ফেলুন নিজেকে। রাশভারী ব্যক্তিত্বের মানুষের নিকট সহকর্মীরা, ছাত্র-ছাত্রীরা আসতে, কথা বলতে স্বস্তিবোধ করেন না। কেউ কাছে আসলেই অন্যের বিপক্ষে অভিযোগ-অনুযোগ প্রদান বা তার কাছ থেকে অন্যের দোষত্রুটি আগ্রহভরে শোনার সুযোগ না দেওয়াটা জরুরী। অপছন্দ হলেই তাকে হেনস্থা বা খাটো করে কথা বললে সহকর্মীরা স্বস্তিবোধ করেন না। তাদেরকে আপন ভাবলে, তারাও আপন ভাববে।

সম্মান দিন, সম্মান নিন

সম্মান সবসময় দ্বীপাক্ষিক হয়। কেবল নেতৃত্বে থাকলেই অধ্বস্তনদের নিকট একতরফা সম্মান প্রত্যাশা করতে নেই। মনে রাখতে হবে কর্মক্ষেত্রে প্রত্যেক সহকর্মীর কর্মপরিধি অনুযায়ী সম্মানের সীমারেখা নির্ধারিত। তাদেরকে তাদের প্রাপ্য সম্মান দিলে নেতৃত্বের আসনে থাকা ব্যক্তি সহজেই সম্মান পাবে।

সৌজন্যতাবোধ

সবার সঙ্গে সৌজন্যতাবোধ বজায় রেখে চলতে হবে। কার পোশাক কেমন, কে দেখতে কেমন, কার ব্যক্তিগত জীবন কেমন, কার রাজনৈতিক দর্শন কি, কার ধর্ম চর্চ্চা কি —এ ধরনের কথাবার্তা কর্মস্থলে খুবই অশোভনীয়। কর্মস্থলে ব্যক্তিগত যে কোনো আলাপ এড়িয়ে চলাই ভালো।

গোছালো মিটিং করুন

পরমর্শ ও তথ্য আদান প্রদান ছাড়া একাডেমিক লিডার এককভাবে কোন সফলতা আনতে পারেন না। তাই তাকে রুটিনমাফিক এবং জরুরী বিভাগীয় ও প্রশাসনিক মিটিং নিয়মিত করতে হয়। মিটিংগুলো অবশ্যই এজেন্ডা ভিত্তিক হতে হবে। মিটিংয়ে এজেন্ডাগুলো ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে তা নোটিশ আকারে সকলকে জানিয়ে দিতে হয়। মিটিংয়ে কাউকে কখনও কটাক্ষ করে কিছু বলতে নেই। অভিযোগ ও দোষারোপ চর্চ্চা যেনো মিটিংয়ে না হয়, সে দিকটি খেয়াল রাখতে হয়।

নিজেকে সাধারণ ভাবতে দিন

নিজেকে অসাধারণ ভাবে উপস্থাপন করবেন না। সহকর্মীদের জীবনাচরনের সাথে আপনার জীবনাচরণ যেনো অনেক বেশী পার্থক্য করে না দেয়- সেই দিকটা লক্ষ্য রাখুন। এব্যাপারে, ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদকে অনুসরণ করতে পারেন। তিনি বলেছিলেন "একজন নেতার জীবনযাপন এমন হওয়া উচিৎ যেমন তাঁর জনগণ যাপন করেন!"

ক্ষমা করতে শিখুন

প্রতিষ্ঠানে কাজ ও দায়ীত্বের চাপে কিংবা পারিবারিক বা ব্যক্তিগত কোন অব্যক্ত কারনে অধ্বস্তদের কেউ কোন একসময় অত্যন্ত অপেশাদার আচরণ করে বসতে পারে। একাডেমিক লিডার হিসাবে আপনার জন্য মনঃক্ষুন্ন হওয়ার মতই বিষয় এটি। এ অবস্থায়ও পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করুন। একদিনের ঘটনা দিয়েই একজনের অনেক বছরের অবদানকে ভুলে না গিয়ে তাকে বুঝার জন্য একটু সময় নিন। তাকে ক্ষমা চাওয়ার, দুংখ প্রকাশ করার ও ভুল স্বীকার করার জন্য একটু সময় দিন। না শুধরালে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে রিপোর্ট করুন। কোন বিষয়কে ব্যক্তিগত আক্রমন হিসাবে না নিতে শিখুন। পারলে ক্ষমা করে দিন। যে ব্যক্তি অন্যকে ক্ষমা করে আল্লাহ তাআলা তার অপরাধ ক্ষমা করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, 'আর যদি তোমরা তাদের মার্জনা করো ও দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করো ও ক্ষমা করো, তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান।

সহকর্মীদের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করুন

একদল দক্ষ সহকর্মীদের নিয়ে কাজ করলে নিজের কর্মদক্ষতাও বৃদ্ধি পায়। একাডেমিক লিডারের কাজ হবে সহকর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে নিয়মিত সহায়তা করা, তাদের উৎসাহ দেয়া ও প্রশিক্ষনে তাদের জড়তা দুর করে একটি ইতিবাচক মনোভাব তৈরী করে দেওয়া। সহকর্মীদের নিয়মিত গবেষণায় ও জার্নালে আর্টিকেল লেখা, কনফারেন্স, সেমিনারে ও ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশ নিতে সহায়তা করুন।

সহকর্মীদের সাময়িক ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যায় যৌক্তিক সুযোগ দিন

কোন এক সহকর্মী যদি কোনদিন অফিসে কিছুটা দেরীতে আসে বা আগে যেতে চায়, কারনটা বুঝার চেষ্টা করুন। হতে পারে তার পরিবারের কেউ অসুস্থ, তার ছোট বাচ্চাটার বিশেষ প্রয়োজন ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের কাজে ব্যাঘাত না ঘটলে তাকে সুযোগ দিন। তবে বিষয়টি যদি প্রতিদিনকার অভ্যাসে পরিণত হয়, তাহলে সুযোগ দেওয়া বন্ধ করে দিন।

কথা বলুন ধীরে, নিচু স্বরে

কর্মক্ষেত্রে চিৎকার করা কিংবা খুব উচ্চস্বরে কথা বলা অভদ্রতার পরিচয়। ধীরে এবং স্পষ্টভাবে কথা বলুন। অযথা কিংবা রেগে গিয়ে চিৎকার করা-কোনোটাই ঠিক না। পরিস্থিতি যেমনই হোক মাথা ঠান্ডা রেখে সেটা মিটিয়ে নিন।

বন্ধুত্ব বা সুসম্পর্কে পক্ষপাতিত্ব নয়

প্রতিষ্ঠানে কোন দায়ীত্বে অনেকটা সময় একসঙ্গে থাকার ফলে সহকর্মীদের মাঝে কেউ কেউ বন্ধুও হয়ে উঠেন। কাজের শেষে একসঙ্গে খেতে যাওয়া, এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি হতেই পারে। এতে কোনো ক্ষতি নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত এই সম্পর্ক কর্মস্থলে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না করে। কোনোভাবেই যেন পক্ষপাতিত্ব না আসে। তবে এক বা একাধিক জনকে বেশী গুরুত্ব দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সহকর্মীদের উপেক্ষা করলে সেটা সম্পর্কহীনতার কারন হতে পারে।

অনৈতিকতা নয়

পুরুষ একাডেমিক লিডারদের একটু বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নারী সহকর্মী ও নারী শিক্ষার্থীদের সাথে অপেশাদার ও অনৈতিক সম্পর্ক নীজ জীবনেও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। নারীদেরকে সম্মানের চোখে দেখতে হবে। তাদের সাথে কোন ভাবেই অশোভন আচরণ নয়। বিষয়টি উভয় পক্ষকেই মেনে চলতে হয়। ক্ষণিকের একটি ভুল প্রতিষ্ঠানের অর্জিত সুনাম ধুলিস্যাত করে দিতে পারে।

নালিশ নয়

সহকর্মীর কোনো আচরণে কষ্ট পেলে বা বিরক্ত হলে তার সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করুন। প্রথমেই কর্তৃপক্ষের কাছে তার বিরুদ্ধে নালিশ করতে যাবেন না। এটি শিশুসুলভ আচরণ। আপনি যদি একটা সমস্যা নিজে কথা বলে সমাধান না করতে পারেন তখন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলুন। সেক্ষেত্রেও নালিশ না করে পুরো ব্যাপারটা জানান এবং সমাধান চেয়ে নিন।

ব্যক্তিগত সম্পর্কে সতর্কতা

একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে করতে দুজনের মধ্যে নির্ভরতা বা ভালোলাগা তৈরি হতেই পারে। তবে এই জাতীয় বিষয় যতটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব এড়িয়ে যাওয়া উচিত। কোনো কারণে যদি সম্পর্ক ভেঙে যায় তখন দুজনের জন্যই একই জায়গায় কাজ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যায়। এ ধরনের বিষয়গুলো যদি প্রতিষ্ঠানে কোন মুখরোচক আলোচনা তৈরী করে ও পরিবেশ বিঘ্নিতকরে, তখনই একাডেমিক লিডার হিসাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে।

অপ্রয়োজনে যোগাযোগ নয়

অফিস সময়ের বাহিরে বা ছুটির দিনে খুব প্রয়োজন না হলে যোগাযোগ করা থেকে বিরত থাকুন সহকর্মীদের সাথে। অপ্রয়োজনে ফোন করা বা সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগ তার ব্যক্তি জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং তিনি নিজেও বিরক্ত হতে পারেন।

হিংসা নয়, সহযোগিতা

সহকর্মীর পদোন্নতি কিংবা বড় দায়িত্ব পাওয়ার পর তাকে হিংসা না করে বরং শুভেচ্ছা জানান। বড় কাজগুলোতে সাহায্য করুন। চমৎকার টিমওয়ার্কের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠানের উন্নতি হবে। কারও কোন অর্জনে তাকে নিয়ে দলবেধেঁ খাওয়া দাওয়া করে শুভেচ্ছা জানিয়ে উপভোগ করলে প্রতিষ্ঠানে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পায় ও মজবুত হয়।

ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখুন

চেষ্টা করুন সবসময় হাসিখুশি থাকার। চারপাশ থেকে নেতিবাচকতা যেন নিজের ভেতর আসতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখুন। যদি হতাশ বোধ করেন তবে তা মোকাবিলা করার কৌশলগুলো প্রয়োগ করুন। তবে সেক্ষেত্রে আশেপাশে থাকা মানুষের যেন সমস্যা না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখুন। হেডফোনে গান শুনুন কিংবা একটু হেঁটে আসুন বাইরে থেকে। এক মগ চা/কফি নিয়ে বারান্দায় বা ক্যাফেটেরিয়ায় বসে সামলে নিন নিজেকে।

সব কিছুকে ইস্যু বানাতে নেই

হয়তো কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে একজন ফোন চালাচ্ছেন, কেউ হয়তো কাজ বাদ দিয়ে গেম খেলছেন। আপনি বিষয়টি খেয়াল করলেও সেই খেয়াল করা পর্যন্তই থাকুন। এটাকে ইস্যু বানানোর কোনো দরকার নেই। কে কী করল, কে কী করল না তাতে আপনার ঢুকে কাজ নেই। আপনি শুধু আপনার কাজ নিয়ে ভাবুন।

একক নয়, সমষ্টিতে বিশ্বাস রাখুন

আপনি যদি সাময়িক ব্যক্তিগত অর্জন বা সফলতা চান, তাহলে একা চলতে পারেন। কিন্তু যদি দীর্ঘমেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদী টেকসই সফলতা চান তাহলে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে দিন। সকলের এবং প্রতিষ্ঠানের কিংবা আপনার বিভাগের সফলতা আপনার অধ্বস্তনদেরকে নিয়েই আনতে হবে। অর্জনটা সকলের ভীতর ভাগ করে দিন। ব্যর্থতাটা নিজের ঘাড়ে নেওয়ার মানসিকতা রাখুন। টিমওয়ার্ক থাকলে সহকর্মীরাই বলবে সফলতাও সকলের, ব্যর্থতাও আমাদের সকলের কোন এক দুর্বলতার ফল। তখন আর কেই কারও উপর দায় চাপাবে না।

আপনি যখন একাডেমিক লিডার, আপনার অবস্থান আপনি সবচেয়ে বেশী ভালো বুঝবেন। নিজ পেশার নেটওয়ার্কিংকে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। গবেষণা ও অধ্যাবসায় বজায় রাখতে হবে। পরিস্থিতি বুঝে আপনাকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। আর হ্যাঁ, নেতৃত্ব ছাড়ার মানসিকতাও রাখতে হবে। অন্যের জন্য পথ ছাড়লেই সামনে আগানো যায়। নেতৃত্ব ছাড়ার জন্য ভবিষ্যৎ নেতৃত্বও তৈরীর মানসিকতা রাখতে হবে।


লেখকঃ অধ্যাপক ড. জুলফিকার হাসান, ডীন, ব্যবসায় প্রশাসন ও অর্থনীতি অনুষদ, সিটি ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ। Email: hasanzulfiqar@yahoo.co.uk  Facebook: www.facebook.com/zulfiqar.hasan.56/

 


Comments